December 23, 2024, 1:02 am
জাহিদুজ্জামান/
বারবার সময় ও অর্থ বৃদ্ধির বিষয়ে তদন্তে আটকে আছে কুষ্টিয়া মেডিকেলের নির্মাণ। তিনমাস আগে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটি মাঠের তদন্ত শেষ করেছে। এখন বিশ্লেষণ এবং রিপোর্ট লেখার কাজ চলছে। এই রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে আছে গণপূর্ত বিভাগ। তারা বলছে, অবশিষ্ট প্রকল্প পাশ না হওয়ায় অনেক কাজের টেন্ডার করা যাচ্ছে না। দুই মাস আগেও যেখানে ৬ থেকে ৭শ শ্রমিক কাজ করতো সেখানে এখন ১শ থেকে দেড়শ শ্রমিক কাজ করছে। ধীরগতির এ নির্মাণ কাজও দেখার কেউ নেই। গণপূর্তের কুষ্টিয়া নির্বাহী প্রকৌশলী রয়েছেন প্রশিক্ষণে, ঢাকায়।
২০১২ সালের ৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেকের সভায় ২৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ের কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর সর্বশেষ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ ধরে সংশোধিত প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৭৪২ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২০ সালের ১২ মার্চ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় ৬৮২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়, মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত। গত ৫ জানুয়ারি সেই প্রস্তাবই যায় একনেকে। কিন্তু তা প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে তা বাতিল করেন। তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর আইএমইডি’র সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে তদন্ত চলছে।
টেলিফোনে কথা হয়, তদন্ত কমিটির প্রধান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীর সঙ্গে। সাংবাদিক জাহিদুজ্জামানকে তিনি বলেছেন, তদন্ত আমরা করে এসেছি, এখন রিপোর্ট লেখা চলছে। মেডিকেলের নির্মাণ কাজ থেমে আছে কী? সাংবাদিক জাহিদুজ্জামান জানতে চাইলে তিনি বলেন এটা গণপূর্ত বিভাগ বলতে পারবে। সচিব প্রদীপ রঞ্জন বলেন, তদন্ত কমিটিতে আমি ছাড়া পরিকল্পনা কমিশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের লোকও আছে। কমিটির সবাই বসে আমরা বিশ্লেষণ করছি। আমরা মূলত দেখছি কীভাবে এতোদিন কাজ এগিয়েছে।
প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ উঠায় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরেও আইএমইডি প্রকল্প পরিদর্শনে এসেছিল। তাদের প্রতিবেদনে প্রকল্পটির সবকটি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেই নকশা পরিবর্তনসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয় প্রকল্পের প্রায় সব ক্ষেত্রে বেঁধে দেওয়া ব্যয়ের সীমা লঙ্ঘন করে অনুমোদন না নিয়ে অর্থ ব্যয়ে ক্রয় আইনের ‘গুরুতর লঙ্ঘন’ করা হয়েছে। সেসময়ও নতুন টেন্ডার হতে দেরী হওয়ায় কাজে ধীরগতি দেখা দেয়।
সরেজমিনে কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী মহাসড়কের পাশে অবস্থিত মেডিকেলের নির্মাণ কাজে চরম ধীরগতি দেখা গেছে। আগের মতো দেখা যায়নি নির্মাণ সামগ্রী বহনকারী ট্রাকের আনাগোনা। ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে দেয়া কাজের মধ্যে মাত্র ৬টি ভাগে কাজ চলতে দেখা যায়। শ্রমিক ও ঠিকাদারদের প্রতিনিধিদের দেয়া হিসেবে সব মিলিয়ে ১২০ থেকে ১৫০ জন শ্রমিক কাজ করছে। কথা হয় শ্রমিক আমির ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, কাজতো বন্ধ হয়ে গেল। কন্ট্রাকটারের লোকজনও চলে গেছে। এখন শ’খানেক লোক আছে। কুষ্টিয়া মেডিকেলে নির্মাণ সাইটের মধ্যে শ্রমিকদের জন্য মুদির দোকান দিয়েছেন হাফিজুর রহমান। তার দোকান এখন একেবারেই ফাঁকা। সাংবাদিক জাহিদুজ্জামানকে হাফিজুর বলেন, এখান থেকে সব লোক চলে গেছে। তিনি বলেন, মাসখানেক আগেও এখানে ৫শ’র বেশি শ্রমিক ছিলো। দোকানী হাফিজুর শুনেছেন, ফান্ড নেই তাই কাজ হচ্ছে না।
তিন মাস আগে জানুয়ারিতে গণপূর্তের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন কুষ্টিয়া মেডিকেলের নির্মাণ কাজ ৫৫ ভাগ এগিয়েছে। এখন কুষ্টিয়া নির্বাহী প্রকৌশলী বা যশোর তত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কার্যালয় জানাতে পারেনি কাজ কতটুকু এগিয়েছে।
কুষ্টিয়া থেকে যশোরে বদলি হওয়া নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম কুষ্টিয়া মেডিকেলের ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন আমি দুই বছর কুষ্টিয়াতে দায়িত্বে ছিলাম। তিনমাস আগে বদলি হয়ে যশোরে এসেছি। তিনি কুষ্টিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণে ঢাকায় অবস্থান করছেন কুষ্টিয়া গণপূর্তের বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম। তিন সপ্তাহের ট্রেনিংয়ে তিনি ১১ এপ্রিল পর্যন্ত থাকবেন। তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে, কুষ্টিয়া গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মাগুরা গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু হায়াত মুহাম্মদ শাকিউল আজম বলেছেন, মেডিকেলের নির্মাণ কাজ চলছে। তবে ডিপিপি সংশোধনের প্রস্তাব পড়ে আছে। এটা ১ থেকে দেড় মাসের মধ্যে সমাধান হবে। একনেকে উঠবে আবার। এটা পাশ হয়ে গেলেই আবার পুরোদমে কাজ শুরু হবে বলেন তিনি। প্রকৌশলী শাকিউল আজম বলেন, সপ্তাহে দুই দিন সোমবার-মঙ্গলবার কুষ্টিয়ায় অফিস করি। সাংবাদিক জাহিদুজ্জামানকে টেলিফোনে তিনি জানান, শেষবার যখন কুষ্টিয়া গিয়েছিলাম আসার পথে একবার একটু দেখতে গিয়েছিলাম মেডিকেলের নির্মাণ কাজ। তিনিও বলতে পারেন নি কতটুকু কাজ এগিয়েছে।
নির্মাণাধীন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পের সুপারভাইজার অফিসার মানিক লাল দাস। তিনি গণপূর্তের যশোর সার্কেলের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। টেলিফোনে মানিক লাল দাস বলেন, আমরা কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলীকে বলে রেখেছি, নির্মাণ কাজ চালিয়ে রাখার জন্য। যে ঠিকাদার যে কাজ করছেন তা চালাবেন। এটা তদন্ত রিপোর্টের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।
সাংবাদিক জাহিদুজ্জামানকে তিনি বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান থাকতে তিনি প্রতিদিন কত লেবার কাজ করছে তার হিসেব পেতেন। নতুন নির্বাহী প্রকৌশলী জয়েন করার পর তিনি আবার ট্রেনিং এ গেছেন। এ কারণে কাজে ধীরগতি আসতে পারে। মানিক লাল বলেন, ১১ তারিখের পর ট্রেনিং থেকে নির্বাহী প্রকৌশলী ফিরে আসলে কাজে গতি আসবে।
মেডিকেলের নির্মাণ কাজের ভবিষ্যতের বিষয়ে তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মানিক লাল দাস সাংবাদিককে বলেন, এখন আমরা তদন্ত রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি। রিপোর্টে যাই থাক যাকে দোষী করুক সমস্যা নেই। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি প্রজেক্ট পাস হওয়া। এটি হলেই বাকী টেন্ডারগুলো করানো সম্ভব হবে। তাহলে দ্রুত কাজ শেষ করা যাবে। মানিক লাল বলেন, ইলেক্ট্রো-ম্যাকানিক্যাল গ্রুপের ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার কাজের টেন্ডার বাকী আছে। এর মধ্যে ২৩টি লিফট, সাব-স্টেশন, জেনারেটর, ওভারহেড লাইন এই গ্রুপের কাজের অন্যতম।
তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মানিক লাল দাস বলেন, ২০১১ সালে প্রকল্পটি পাশ হয় ২০০৮ এর সিডিউলে। তখনই উচিৎ ছিলো গণপূর্তের কর্মকর্তাদের টেন্ডারে না গিয়ে সিডিউল রেট পরিবর্তন করে রিভিশন পাশ করে নেয়া। কিন্তু তা না করে ২০০৮ সালের মূল্যে ২০১২ সালে কাজ করতে গিয়ে সমস্যা শুরু হয়। পরে ২০১৮ সালেও একইভাবে রিভিশন পাশ হয়। বারবারই পূর্বের প্রাক্কলন মোতাবেক প্রকল্প পাশ হওয়ায় কাজ করতে গিয়ে অর্থে পোষায়নি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কাজের শুরুর দিকে দুই প্রকৌশলীর দায়িত্বহীনতা, ছোট ছোট প্যাকেজে কাজ ভাগ করা, ছাদ ধসে পড়া ও অনিয়মে কাজ বন্ধ থাকা এবং প্রকল্প পরিচালকের অদক্ষতার কারণে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের কাজ ঠিকমতো এগোয়নি। যে কাজ ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা ২০২১ সালে এসে তার অর্ধেকমাত্র হয়েছে।
কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ব্যাপারে প্রকৌশলী মানিক লাল দাস বলেন, এসবের সঙ্গে আমি কোনভাবেই জড়িত না। প্রকল্পের এখন দ্বিতীয় রিভিশনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। এটা তৎকালীন কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান হেড অফিসে পাঠিয়েছে। সেখান থেকে পিডির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে গেছে। আমার মাধ্যমে কোন কিছু যায়নি। জাহিদুজ্জামানকে তিনি বলেন, এখানে আমি দায়িত্ব নেয়ার সময়ই প্রকল্পের প্রথম রিভিশন পাশ হয়েছে। ২০১৪ সালের সিডিউলে রিভিশন পাশ হয় ২০১৮ সালে।
এরপরে এ বছরে এসে আরেকটি রিভিশন দিতে গেলে ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী। সেখানেই আটকে আছে সব। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিলে পরে রিভিশন পাশ হবে। তখন আবার টেন্ডার হবে। ৫ কোটি টাকার মধ্যে হলে আমি পাশ করতে পারবো। ১০ কোটি পর্যন্ত অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রধান প্রকৌশলী, ৫০ কোটি পর্যন্ত পাস করবে মন্ত্রণালয় এর ওপরে গেলে পাশ করবে ক্রয় কমিটি।
মানিক লাল দাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো- দীর্ঘদিন ধরে এ কাজের সাথে থাকলেও সাইট পরিদর্শনে আসেন না ঠিকমত। মেডিকেলের ঠিকাদারদের কাছ থেকে সুবিধা নেয়ার মত অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া অন্য ঠিকাদারদের যেখানে কাজের মেয়াদ শেষ সেখানে একজন ঠিকাদার জহুরুল ইসলামের মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছেন ২০২২ সাল পর্যন্ত। ঠিকাদার জহুরুলের প্যাকেজের কাজেই ২০১৯ সালের ১৭ই জানুয়ারি হাসপাতাল ভবনের গাড়ি বারান্দার ছাদ ধসে পড়ে। এরপর প্রকল্পের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দায়িত্বে অবহেলা ও অনিয়মের অভিযোগে গণপুর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী, এসডি, এসও সহ ৪ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়। দুইজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনাও কাজে ধীর গতি আনে। পরে ঠিকাদার জহুরুলকে কালো তালিকাভুক্ত করা হলেও তিনি পার পেয়ে যান আদালতে রিট করে। তবে, নিজে কোন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নন বলে জানান মানিক লাল দাস। সাংবাদিককে তিনি বলেন, ইস্টিমেট এবং টেন্ডার পাস করা এবং মাঝে মাঝে প্রকল্প এলাকা ভিজিট করে পরামর্শ দেয়া আমার কাজ। তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব নির্বাহী প্রকৌশলীর। মানিক লাল বলেন, যেহেতু নতুন রিভিশন পাশ হয়নি, টেন্ডার বন্ধ রয়েছে। তাই গত জানুয়ারির পর আমি আর সাইট ভিজিট করেনি।
২০১১ সালে কুষ্টিয়া শহরে মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট টেনিং ইনস্টিটিউট (ম্যাটস) ভবনে অস্থায়ীভাবে যাত্রা শুরু হয় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের। জোড়াতালি দিয়ে কোনমতে চলছে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের পাঠদান। শিক্ষার্থীরা নতুন ক্যাম্পাসে যেতে উদগ্রীব।
Leave a Reply