December 23, 2024, 6:46 am
দৈনিক কুষ্টিয়া প্রতিবেদক/
সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যম দিয়ে কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির মূল্যের অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) করা হচ্ছে। শেষ হলেই আবার বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হবে- জানিয়েছেন, পাট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. খুরশীদ ইকবাল রেজভী।
তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের অধিবাসী সুতা ব্যবসায়ী মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ১৯০৮ সালে কুষ্টিয়া শহরে ৯৯ বিঘা জমির উপর মিলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর শাড়ি, ধূতি, মার্কিন ও অন্য কাপড়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পাকিস্তান সরকার মিলটিকে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ‘ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন- ইপিআইডিসিকে পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। এর আগ পর্যন্ত মিলটি লাভজনক ছিলো। মধুর ছিলো মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক। জমজমাট ছিলো কুষ্টিয়ার এ এলাকাটি। প্রথমে মাত্র আটটি তাঁত এবং কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে শুরু করলেও একসময় এখানে পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করেছে। এদের বেতনছাড়াও লাভের ওপর বোনাস, চিকিৎসা খরচ দিতেন মালিক পক্ষ। নিরাপত্তায় বিশ^স্ততার জন্য নেপাল থেকে প্রহরী ও অন্য কর্মচারী এনেছিলেন। তাদের জন্য তৈরি করেন নেপালি কোয়ার্টার। এ মিলের কারণেই এলাকাটির নাম হয়ে যায় মিলপাড়া। তবে, জীবনযাত্রার উন্নয়ন এবং জমজমাট জনউপস্থিতির কারণে এ মিলের আশপাশের এলাকাকে ছোট্ট কলকাতা নামে ডাকতে শুরু করেন স্থানীয়রা।
পূর্বদিকের একটি তামাক কারখানার কারণে এখন দু-একজনের আনাগোনা থাকলেও সেই জমজমাট মোহিনী মিল এলাকাটি একেবারে শুনশান। এর সুউচ্চ মাস্তুল ভেঙ্গে ছোট হয়ে গেছে। খসে পড়ছে কিন্তু মার্জিত রূচি নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে এর গেট এর চারিদিকের স্থাপনা। কয়েকজন আনসার সদস্য ক্যাম্প করে আছেন নিরাপত্তার দায়িত্বে। খসে পড়ছে সেই আমলে তৈরি করা ঝুল বারান্দা। দেয়ালে, ছাদের কার্ণিশে বড় বড় বট গাছ বেড়ে চলেছে। আর মিলের ভেতরটা একেবার ঘন জঙ্গলের রূপ নিয়েছে। এটি এখন এখন নানান জাতের সাপ, শেয়াল এবং বিলুপ্ত হতে চলা অনেক প্রাণির আবাস হয়ে উঠেছে। অনেক যন্ত্রপাতি চুরি হয়েছে। বাকীসব এমনভাবে মুখ থুবরে পড়ে আছে যেন মাটির গভীরে চলে যেতে চায়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সরকার মোহিনী মিলকে জাতীয়করণ করে বঙ্গবন্ধু সরকার। স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার ইশারা, শ্রমিক ইউনিয়নের ষড়যন্ত্র ও আমলাদের দুর্নীতির কারণে এরপরপরই কারখানাটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এর জন্য জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী রবিউল ইসলাম এবং তার অন্য সহযোগীদের দায়ী করেন বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র আনোয়ার আলী। শ্রমিকদের কল্যাণের কথা চিন্তা করে মিলটিকে আগের মতো সচল করার দাবি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন আনোয়ার আলী। তিনি বলেন, মিল প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করে স্থানীয় চক্রটি এর অভ্যন্তরের পিতল, লোহা ও অন্যান্য ধাতব যন্ত্রপাতি বের করে বিক্রি করে দিয়েছেন। টেলিফোনে জানতে চাওয়া হলে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী রবিউল ইসলাম এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, মোহিনী মিল সরকার পরিচালন করতেন সেখানে আমার সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ নেই। আনোয়ার আলী আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, তাই আমাকে রাজনৈতিকভাবে ড্যামেজ (ক্ষতি) করার জন্য এসব কথা বলে থাকতে পারেন। একটি জমি জালিয়াতি মামলায় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী রবিউল ইসলামের নাম আসায় মোহিনী মিল ধ্বংসের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
লোকসানে চলতে শুরু করলে ১৯৮৪ সালে শিল্পপতি নজরুল ইসলামের কাছে মাত্র ২৫ কোটি ২৬ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয়া হয় মিলটি। সেসময়ই এর জমির দামই ১০০ কোটিরও ওপরে ছিল। এই মালিক মোহিনী মিলের নামই বদলে দেন। এটি হয়ে যায় ‘শাহ মখদুম টেক্সটাইল মিল’। বড়বাজার অগ্রণী ব্যাংক থেকে আট কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরের বছরই মিলটি চালু করা হয়। নতুন মালিক সরকারের চুক্তি ভঙ্গ করায় এবং শ্রমিকদের ১০ মাসের বেতন বাকি পড়ায় ১৯৮৭ সালে লে-অফ ঘোষণা করা হলে পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে যায় এ প্রাচীণ এতিয্য।
১৯৯০ সালে মিলটি দখলে নিয়ে বিক্রির উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু ব্যাংক ও আগের ক্রেতা নজরুল ইসলাম মামলা করলে আদালতের নিষেধাজ্ঞায় বিক্রি কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। মামলা এবং বকেয়া পাওনা নিয়ে জাটিলতা থাকায় মিলটি আরেকদফা হাতবদল হলেও চালু করা যায়নি। এরপর ২০০৯ সালে আবার মিলটি চালুর উদোগ নেয় সরকার। দি পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস কর্পোরেশন লিমিটেড সরকার, মিল মালিক ও ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সাথে মধ্যস্থতা শুরু করে। ধীরে ধীরে সরকার এবং ব্যাংকের কাছে থাকা বকেয়া পরিশোধের শর্তে আবার পূর্বের মালিক শাহ মখদুম গ্রুপের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এরপর যন্ত্রপাতি বিএমআরই বা আধুনিকায়ন ও পুনঃস্থাপন করে মিলের একটি ভবনে সুতা তৈরির একটি ইউনিট চালু করা হয়। এটিও বন্ধ হয়ে যায়। ২০১১ সালে কুষ্টিয়া থানায় করা জিডির সূত্রে নিশ্চিত হওয়া য়ায় এ বছরেই চুরি যায় মিলের অনেক যন্ত্রাংশ। এর পরেও হাতবদল হয়েছে মিলটি। আব্দুল মতিন নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিক্রির চুক্তি করে সরকার। তারা কিছু টাকা পরিশোধ করে ২০১১ সাল পর্যন্ত। এরপর ২০১২ সালে মিল দেয়া হয় মেসার্স দিনার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এম আসলামকে। টাকা পরিশোধের জন্য তাকে সময় দেয়া হয় ২৮ দিন। মাত্র ছয় কোটি টাকা দিতে সক্ষম হলে পরে মন্ত্রণালয় ইনারগোটেক লিমিটেডকে মিল দিয়ে দেয়। জমিসহ মিলটির দাম ৪৮ কোটি ৩৯ লাখ ৭৩ হাজার টাকা ধরে ইনারগোটেক লিমিটেডের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারাও সময়মতো টাকা না দেওয়ায় মিলটি এখন পাট মন্ত্রণালয়ের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া বা ধার পরিশোধ নিয়ে কাজ করে যে শাখা সেই লিকুইডেশন বা অবসায়ন শাখার তত্ববধানে। মন্ত্রণালয়ের পাট শাখার যুগ্ম সচিব মো. খুরশীদ ইকবাল রেজভী বলেন, মিলটির বর্তমান মূল্যের মূল্যায়ণ চলছে। এর স্থাবর সম্পতির মূল্যায়ণ করছেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আর অস্থাবর সম্পতির মূল্য নিধারণের জন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র আনোয়ার আলী যিনি এই মিল রক্ষায় আন্দোলন করেছেন বললেন, মিলটি নিয়ে সীমাহীন অনিয়ম দুর্ণীতি হয়েছে।
তার মতে মোহিনী মিলের সঙ্গে এ জেলার মানুষের আবেগ জড়িত। এটিকে ঘিরে এখনও মানুষের অনেক রকম প্রত্যাশা কাজ করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এটি আর বস্ত্রকল হিসেবে চালু করার আর কোন সুযোগ নেই। তাই যেনতেন বিক্রি না করে সরকারের উচিৎ হবে ভাল কোন শিল্পপতিকে খুঁজে বের করা যিনি এখানে নতুন কোন ব্যবসা করে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করতে পারেন- বলে মত দেন তিনি।
Leave a Reply