December 22, 2024, 7:56 pm
একটি দৈনিক কুষ্টিয়া বিশেষ প্রতিবেদন/
সুযোগ পেলেই বাড়ানো হয় চালের দাম। আকুতি-মিনতি, দেশ-দশের কোন ব্যাপার নেই। এটা হয়ে আসছে। মানুষও এখন অভ্যস্ত। মেনেই নিয়েছে তারা এই জিম্মিদশা থেকে মুক্তি নেই। গত বৃহস্পতিবার কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সাথে বৈঠকে কুষ্টিয়ার চাল উৎপাদনকারীরা সেই চিরাচরিত খোঁড়া অজুহাতই সামনে আনেন। ধানের দাম বাড়ছে তাই চালের দাম বাড়ছে। জেলা প্রশাসকেরও সেই একই অনুরোধ বেশি মূনাফা লাভের আশায় অযথা চালের দাম বৃদ্ধি করবেন না।
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আতিকুর রহমান আতিক, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসার মনোয়ার হোসেন, কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জুবায়ের হোসেন চৌধুরীসহ চালকল মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ। আরো উপস্থি ছিলেন, কুষ্টিয়া জেলা অটো মেজর এন্ড হাস্কিং মিলের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন, বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স এসোসিয়েশন কুষ্টিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মফিজুল ইসলাম ও সমিতির উপদেষ্টা এমএ খালেক প্রমূখ।
হিসেব করে দেখা যাচ্ছে বাজারে আবারও চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। করোনাভাইরাস আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার শুরুতেই চাল বিক্রি বেড়ে যায়, এতে দাম বাড়ে। গত মাসের মাসের ১১ তারিখে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চাল, আটা, আলু, পেঁয়াজ, রসুনের স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎসে আয়কর কমানো হয়েছে। এর ফলে এসব পণ্যের দাম কমার কথা থাকলেও বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম; যা অব্যাহত রয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশের যেকোনও দুর্যোগের সময় সুযোগ নিয়ে বাড়ানো হয় চালের দাম। কিন্তু কেউ এর দায় স্বীকার করে না।
চালের মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে এবার ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধানের দাম বেড়েছে, তাই চালের দামও বাড়ছে। আবার অনেকে বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় রেড জোন ঘোষণা করে সেখানে লকডাউন দেওয়া হচ্ছে এই ঘোষণায়ও বেড়েছে চালের দাম। এক্ষেত্রে আড়তদাররা পাইকারি ব্যবসায়ীদের এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা খুচরা ব্যবসায়ীদের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই চাতাল ব্যবসায়ীদেরও।
চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটোরাইচ মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন কুষ্টিয়া জেলা শাখার সভাপতি ওমর ফারুকের বক্তব্য হলো ধানের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় চালের দাম পবড়েছে। চালের বাজার শিথিল রাখতে হলে ধানের দাম কমাতে হবে। ধানের দাম বৃদ্ধি পেলে চালের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তিনি আরো বলেন- এবছরে ঘূর্নিঝড় আম্পানে ধানের ক্ষতি হওয়ায় কৃষকেরা ভালো ধান ঘরে তুলতে না পারায় সমস্যা হচ্ছে। এতে কৃষকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার দাবি বেশি দামে ধান কিনে কম দামে চাল বিক্রি করলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বাজারগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতিকেজি মোটা চালের দাম ৪০ থেকে ৪২ টাকা, আর চিকন চাল নাজিরশাইল ও মিনিকেটের কেজি ৬০ টাকা। কিছু দিন আগেও মোটা চালের দাম ছিল ৩৮ টাকা। ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া মাঝারি মানের চালের দাম বেড়ে হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। চিকন চালের দাম বেড়ে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৬২ টাকা, যা আগে ছিল ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর তথ্য মতে, গত কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা চালের মধ্যে প্রতি কেজি স্বর্ণজাতের চালের দাম বেড়েছে দুই দশমিক ৪৭ শতাংশ। মাঝারি আকারের চালের মধ্যে প্রতি কেজি পাইজাম চালের দাম বেড়েছে চার দশমিক ১৭ শতাংশ। সরু চালের মধ্যে নাজিরশাইল ও মিনিকেট চালের দাম বেড়েছে কেজিতে পাঁচ দশমিক ১৭ শতাংশ।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারগুলোয় এখন প্রতি মণ ধানের দাম ৮০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে রয়েছে; যা গত বছর ৬৫০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকার মধ্যে ছিল। আমন ও বোরোর বাম্পার ফলনের পরও ধানের দাম বাড়লো কেন এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাজারে নতুন করে চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও কেনা হচ্ছে চাল ও ধান। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়েছে ধানের দাম।
এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার বোরো সংগ্রহের ক্ষেত্রে চলতি মৌসুমে একজন কৃষকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ তিন টন থেকে বাড়িয়ে ছয় টন করে ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ১৪ জুন ‘অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ নীতিমালা ২০১৭’ সংশোধন করে এ পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় এবং এ বিষয়ে ব্যব¯’া নেওয়ার জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
চলতি বোরো মৌসুমে সরকারিভাবে আট লাখ টন ধান এবং ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং দেড় লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ২৭ মে থেকে বোরো চাল কেনা শুরু হয়েছে। ধান-চাল সংগ্রহ শেষ হবে ৩১ আগস্ট। সরকারের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ বছর ২৬ টাকা কেজি দরে ধান, ৩৬ টাকা কেজি দরে সিদ্ধ চাল এবং ৩৫ টাকা কেজি দরে আতপ চাল কেনা হচ্ছে।
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ৪৭ লাখ ৪৯ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। এরমধ্যে ৯ লাখ হেক্টরে হাইব্রিড, ৩৮ লাখ ২০ হাজার হেক্টরে উফশী এবং ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে ¯’ানীয় জাতের বোরো ধান আবাদ করা হয়। যদিও চলতি বোরো মৌসুমে দেশে মোট ৪৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আগের তিন বছরে ধারাবাহিকভাবে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। আর এবারের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা গত বছরের কাছাকাছিই রয়েছে। গত বছর উৎপাদন ছিল হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ১৫ টন করে মোট দুই কোটি তিন লাখ ৮৮ হাজার টন।
আম্পান বা অন্য কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগে ধান সংগ্রহে কোন প্রভাব পড়েনি। তাহলে এমন অজুহাতের মানে কি ? শুধুই মুনাফা লাভ ?
এ প্রসঙ্গে জানতে বাংলাদেশ অটো মেজর হাসকিং মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ বলছেন ‘মোকামে কোনও ধরনের চালের দামই বাড়েনি। চিকন চাল ৫০ টাকার নিচে বিক্রি করা হচ্ছে। মোটা চালের দামও বাড়েনি। খুচরা বাজারে যত গন্ডগোল হচ্ছে।’
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন চালকল মালিকদের যথারীতি অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন করোনা মহামারী সময়ে কারোরই দিন ভাল যাচ্ছে না। তিনি অসহায় মানুষের কথা একটু চিন্ত করে চালের দাম শিথিল রাখার কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, বাজার মনিটরিং টিম প্রতিনিয়ত অভিযান চালাবে খাজানগরের সকল মিলে। সরকার যে রেটে চাল বিক্রির নির্দেশনা দেন। চালের বাজার বৃদ্ধি হলে কঠোর ব্যব¯’া নেওয়া হবে বলে জানান।
Leave a Reply