December 21, 2024, 11:25 pm
একটি দৈনিক কুষ্টিয়া প্রতিবেদন/
আজ ঐতিহাসিক ৭ জুন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। আন্দোলন, সংগ্রাম জেল-জুলুম-শোষণ-নির্যতনের এক পর্যায়ে এদিনেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। এটি ছিলো রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামের যে রোডম্যাপ সেখানে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের ইতিহাসে ছয় দফার ভূমিকা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ছয় দফাকে তাই বাঙালির মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা। বঙ্গবন্ধু নিজেই বরেছিলেন “আমাদের বাঁচার দাবি”।
পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই একমাত্র বঙ্গবন্ধইু উপলব্ধি করেছিলেন, এই রাষ্ট্র বাঙালির জন্য তৈরি হয়নি। একদিন বাঙালিকেই বাঙালির ভাগ্যনিয়ন্তা হতে হবে। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই তাই এই একজন মানুষ (বঙ্গবন্ধু) তার লক্ষ্যও নির্ধারণ করে ফেলেছিলেন। ৬ দফা ছিল রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটি ধাপ।
ঐতিহাসিক ৬ দফা স্বৈরাচারী পাকি শাসক আইয়ুব সরকারের মসনদের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এর প্রতি জনসর্মন দেখে এতটাই ভীতু হয়ে পড়ে তারা যে বঙ্গবন্ধুকে ৮ মে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে ১৯৬৯’র ২২ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ একটানা ৩৩ মাস কারাবন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর ১৪ বছরের কারাজীবনে এটাই ছিল দীর্ঘ কারাবাস।
পাকিস্তানি শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে নিখিল পাকিস্থান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্থানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দল নিয়ে এক জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয় ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দিন অনুষ্ঠিত সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে ৬ দফা উত্থাপন করেন। পরের দিন সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে যাতে এটি স্থান পায়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর এই দাবির প্রতি আয়োজক পক্ষ গুরুত্ব প্রদান করেননি। তারা এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যোগ না দিয়ে লাহোরে অবস্থানকালেই ছয় দফা উত্থাপন করেন। এ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন খবরের কাগজে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বলে চিহ্নিত করা হয়। পরে ঢাকায় ফিরে বঙ্গবন্ধু ১৩ মার্চ ছয় দফা এবং এ ব্যাপারে দলের অন্যান্য বিস্তারিত কর্মসূচি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদে পাস করিয়ে নেন।
কি ছিল ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবির মধ্যে ?
প্রস্তাব-১ :
শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি:
দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে যেখানে পাকিস্থান হবে একটি ফেডারেশন ভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্টারী ধরনের। আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম। এবং এই পরিষদও নির্বাচিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণের সরাসরি ভোটে।
প্রস্তাব-২ : কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা:
কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দু’টি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে- যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
প্রস্তাব-৩ : মুদ্রা বা অর্থ-সমন্ধীয় ক্ষমতা:
মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দু’টির যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারেঃ-
(ক) সমগ্র দেশের জন্যে দু’টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
অথবা
(খ)বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবল মাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।
প্রস্তাব-৪ : রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োাজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলির সবরকমের করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।
প্রস্তাব-৫ : বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা:
(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
(খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে।
(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োাজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে।
(ঘ) অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন রকম বাধা-নিষেধ থাকবে না।
(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
প্রস্তাব-৬ : আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা:
আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
সামরিক শাসক আইয়ুব খান বিচলিত হতেই থাকেন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ছয় দফা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেওয়া হবে। ছয় দফা কর্মসূচি জনগণের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সমগ্র পূর্ব বাংলা সফর করেন। ছয় দফাকে বাঙালির বাঁচার দাবি হিসেবে অভিহিত করেন।
ঐতিহাসিক ৬-দফা দিবস’-কে যথাযথ মর্যাদার সাথে পালন করে আসছে দেশবাসী।
Leave a Reply