December 22, 2024, 8:23 am
ড. আমানুর আমান/
বাউল শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধক মহামতি ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৩তম তিরোধান দিবস আজ। এ দিবস উপলক্ষে তিন দিনের একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায়, লালনের আখড়াবাড়িতে। সন্ধ্যায় উদ্ধোধন হবে এ অনুষ্ঠানের। এটি একটি আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। প্রতিবছরই সরকারী উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে। সেখানে দেশ বিদেশ থেকে সমাগম ঘটে প্রচুর বাউল, বাউল অনুসারী ও বাউল গবেষক। ইতোমধ্যে এ সাধুসঙ্গে সাধু-বাউল-ফকিররা যোগ দিয়েছেন। যুক্ত হয়েছেন পর্যটক দর্শনার্থীরা। এখানে শুরু হয়েছে সাধুসঙ্গ। প্রায় দুশো বছর আগে ফকির লালন সাঁই এই ছেউড়িয়ায় দোল পূর্ণিমার তীথিতে সাধুসঙ্গ করতেন। উৎসব চলবে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত।
লালন ছিলেন ‘অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, অহিংস’ দর্শনের অন্যতম পুরোধা। গানের মধ্য দিয়েই যে দর্শনের আর্বিভাব।
১৮৯০ সালের ১৬ অক্টোবর (পহেলা কার্তিক) আজ থেকে প্রায় ১৩২ বছর আগে দেহত্যাগের পর থেকে লালনের অনুসারী শিষ্যরা লালনের তিরোধান দিবস পালনের উদ্যোগ নেন। বর্তমানে সরকারী ও বেসরাকরীরভাবে নিয়ন্ত্রিত লালন একাডেমি এ দিবস পালন করে থাকে। প্রতিবছরই এ উপলক্ষ্যে তিনদিনের নানা কর্মসূচী নেয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছে লালনের জীবন ও কর্মের উপর আলোচনা সভা, গ্রামীন মেলা।
লালন ছিলেন উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধক। সমসাময়িক তার তুল্য অন্য কেউ ছিলেন না। অনুমান করা হয়ে থাকে প্রায় ২ হাজারের বেশী গান লিখেছেন তিনি। এখন পর্যন্ত লালনের লেখা বাউল গানগুলোই দেশ-বিদেশে সবচে বেশী জনপ্রিয়। অনেকগুলো বিদেশী ভাষাতে লালনের গান অনুদিত হয়েছে। লালনের উপর শতাধিক গবেষণা গ্রš’ ও অন্যান্য পুস্তক রচিত হয়েছে। এটাও ইতিহাসে বিরল।
শুধু গানকে উপজীব্য করে একটি সমগ্র দর্শন-ভিত্তি নির্মাণের কৃতিত্ব লালনেরই সবথেকে বেশী। ভিন্ন ভিন্ন এ ধরনের ঘরানা থাকলেও লালন ছিলেন ব্যতিক্রম ; অতুলণীয়। কারন তার গান-দর্শন কয়েকটি ভিত্তি রচনা করেছিল। তারমধ্যে মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িক মনোভাব, জাত-ধর্ম ভেদাভেদহীন কুসংস্কামুক্ত সমাজ চিন্তা অন্যতম।
বাংলার ভাবের জমিনে দাঁড়িয়ে যিনি কর্তারূপে মানুষ অন্বেষণের ইশারা করেছিলেন তাকে নিছকই ভাবগত একটা ব্যাপার ভাবলে আমরা তাঁর কিছুই বুঝব না। বাউলধর্মে পরমার্থ এসে দেহের সীমায় মিশেছে বলেই বাউলদের সাধন-ভজনের মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে মানুষ। তাদের কাছে মানবের তুল্য কিছুই নাই। বিভক্ত সমাজে মানুষের জন্য এ কত অদ্ভূত হেঁয়ালি যে, মানুষ ভজলেই কেবল মানুষ পাওয়া যাবে। এর অন্যথা হলো তো মূলবস্তুটাই হারিয়ে গেল। বাউলদের এই মানুষ ভাবনা শাস্ত্রাচারী সমাজপতি ও ধর্মাধিপতিদের বির“দ্ধে গভীর মর্মজাত এক প্রতিরোধ। লালনের অসংখ্য গানে মনের মানুষের প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন মনের মানুষ এর কোন ধর্ম, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ, কূল নেই। সকল মানুষের মনে বাস করেন ঈশ্বর। সমাজের সকল নিপীড়ন, মানুষের প্রতিবাদহীনতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি-কুসংস্কার, লোভ, সামাজিক বিভেদ, আত্মকেন্দ্রিকতাকে তিনি তাঁর গানের মধ্যে তুলে এনে করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ।
লালনের তিরোধান দিবস উপলক্ষে ভক্তরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এবারও এসেছিলেন নানা আত্মিক বাসনা নিয়ে। সরল সহজভাবে জীবন অনুসন্ধানের প্রত্যয় নিয়েও এসেছেন অনেকেই।
আবার সাধু-ভক্তদের পাশাপাশি বাউল সম্রাটের মাজারটি টানেও এসেছেন অনেক পর্যটক। আসছেন দেশি-বিদেশি গবেষকগণও।
লালনের আখড়াবােিত লালনের আধ্যাত্ম চেতনায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন এমন অসংখ্য বাউলের সন্ধান পাওয়া যায়। তাদের মতো একজন বাউল ফকির হৃদয় শাহ। কুষ্টিয়াতে লালনের আখড়াবােিত থাকছেন বেশকিছু বছর ধরে। তিনি জানান তার দৃষ্টিতে বাউল দর্শন অসীম। কোন কোন ক্ষেত্রে কিছুটা জটিল হলেও লালনের বাউল দর্শনটি অনেক বেশী সহজ ও সাধারণ্যে মিলিয়ে দিতে পারা একটি আত্মদর্শন। সাধারণ মানুষও এ দর্শনের পরশ পেতে পারে যদি সে লালনকে প্রকৃতভাবেই ধারন করতে পারে।
Leave a Reply