December 22, 2024, 3:03 pm
সূত্র, বাংলা ট্রিবিউন/
নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবইয়ে বয়ঃসন্ধিকাল পড়ানো নিয়ে দেশের কিছু ইসলামিক দল, ধর্মীয় সংগঠনের পক্ষে বিতর্ক তোলা হলেও কওমি মাদ্রাসাগুলোয় যৌনশিক্ষা পড়ানো হয় খোলামেলাভাবেই। কওমি মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ানো হয় মা-লা-বুদ্দা মিনহু কিতাব। সহবাস করার নিয়মকানুন থেকে শুরু করে যৌনশিক্ষার পাঠ রয়েছে কওমি সিলেবাসভুক্ত এই কিতাবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, পাঠ্যবইয়ে বয়ঃসন্ধিকাল পড়ানো নিয়ে বিতর্ক উসকে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে একটি চিহ্নিত জাতীয় দৈনিকে ‘৬ষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে যৌনতার সুড়সুড়ি’ শিরোনামে প্রতিবেদনও প্রকাশ করে বলা হয়েছে—এটি ইসলাম ও ঈমানের বরখেলাপ।
এসব বিতর্কের পর গত ২৭ মার্চ আশুলিয়ার ব্রাক সিডিএম সেন্টারে অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালায় এর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কর্মশালায় বলা হয়েছে, ‘ধর্মীয় বইয়ে বা ধর্মগ্রন্থে যৌনশিক্ষা ও বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে আলোচনা থাকলে পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক কেন? ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক কারণে বিরোধিতা করার জন্যই বিরোধিতা করা হচ্ছে।’
কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’ (বেফাক)-এর সহসভাপতি মুসলেহ উদ্দিন রাজু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যা ইসলাম অনুমোদন করে তা পাঠ্যবইয়ে থাকতে পারে। তবে শিক্ষার্থীর বয়স বিবেচনা করে তা পড়াতে হবে। কওমির সিলেবাসে যৌনশিক্ষা পড়ানো হয়। মা-লা-বুদ্দা মিনহু কিতাব পড়ানো হয় সপ্তম শ্রেণিতে। গোসল ফরজের বিষয়টি আমাদের সিলেবাসে যে ক্লাসে ছিল সেই ক্লাসে বাচ্চা প্রাপ্তবয়স্ক হয় না, তাই এটি সরিয়ে দিয়েছি। দেখতে হবে ধর্ম বিষয়টির অনুমোদন দিচ্ছে কিনা?
তাহলে কেন এত বিতর্ক জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনীতি থাকবেই। কেউ ভালো কথা বলবে, কেউ ভালো কথাকেও খারাপ বলবে। কেউ আছে ত্রুটিটাকে সামনে নিয়ে আসবে। পাঠ্যপুস্তকেও ভুল হতে পারে। সেটি শুধরানো যায়। আর কেউ আছেন ভুল ধরার জন্য বসে থাকবে। অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে করেন। ফেসবুকে অনেক সময় বিভ্রান্তি ছড়ানো হতে পারে।’
পাঠ্যবইয়ে বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বয়ঃসন্ধিকাল বা যৌনশিক্ষা নিয়ে কোনও বিরোধিতা নেই বলে জানিয়েছেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “বেহেস্তি জেওরে যৌন শিক্ষা নিয়ে অল্প কিছু বলা আছে। কিন্তু এনসিটিবির যৌনশিক্ষার মধ্যে অনেক কিছুই বলা হয়েছে তারপর যে বিষয়টি আছে, সেটি ইশারা-ইঙ্গিতে এবং দু-একটি বাক্য আমরা দেখেছি, অনেকে পড়ে শুনিয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে ‘বিবাহপূর্ব সম্পর্ক যেটা আছে, এটা নিজেদের সম্মতিতে হলে সমস্যা নেই’। এই ম্যাসেজটা যদি প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া হয়, তাহলে কী পর্যায়ে যাবে? আপত্তিটা এখানেই।”
এছাড়া বয়ঃসন্ধিকালে শরীর পরিবর্তন নিয়ে এনসিটিবির পাঠ্যবইয়ে যা বলা হয়েছে তা নিয়ে কোনও আপত্তি নেই উল্লেখ করে অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলেন, “শরীরে পরিবর্তন, মানসিকতার পরিবর্তন ঘটবে এ কথাগুলো বলুক সমস্যা নেই। আপত্তি শুধু—‘নিজেদের সম্মতিতে যৌনমিলনে সমস্যা নেই’, সে বিষয়টিতেই।”
‘নিজেদের সম্মতি থাকলে যৌন মিলনে সমস্যা নেই’ পাঠ্যবইয়ে এমন বিষয় আছে কিনা জানতে চাইলে এনসিটিবিরি সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘পাঠ্যবইয়ে এটি নেই। কোথাকার কোনও একটি বইয়ের ছবি তুলে ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছিল। আমরা তার জবাব দিয়েছি। ওইটি আমাদের বই নয়। কোত্থেকে এনেছে জানি না। তারা দাবি করেছে ষষ্ঠ শ্রেণির বই। আমাদের বইয়ে এ ধরনের কোনও কথা নেই।’
গত ২৭ মার্চ নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনে লেখকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় বলা হয়েছে, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক কারণে যত বিরোধিতাই হোক আমরা পিছিয়ে যাবো না। আশুলিয়ার ব্রাক সিডিএম সেন্টারে কর্মশালার উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। পাঠ্যবই লেখকরাও এই কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলেন।
কর্মশালায় বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিতর্কের জন্য বিতর্ক করা হচ্ছে। ইসলামিক বইয়ে যৌনশিক্ষা ও বয়সন্ধিকালের শিক্ষা খোলামেলাভাবে লেখা আছে। কওমি মাদ্রাসায় কম বয়সী শিক্ষার্থীদের সেসব পড়ানো হয়। যৌনশিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজনীয় বিষয়। তা হলে বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীরা ভুল করতে পারে, সে কারণে পাঠ্যবইয়ে তা তুলে ধরা হয়েছে।
কর্মশালায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘যেসব দেশের ভাষা আরবি, সেসব দেশে টু, থ্রি, ফোর ও ফাইভের বাচ্চারা তো আরবি বোঝে। পবিত্র কোরান থেকে যদি পড়ে তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু নিজে যা বহন করছে শরীরে—যেমন হার্ট আছে, তেমনি প্রজননতন্ত্রও আছে। সেটি পড়লে সমস্যা কোনো?’
পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘নির্বাচনের বছর, রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে বিরোধিতা করা হচ্ছে। আর আরেকটি পক্ষ রয়েছে, যারা ধর্মটাকে অপব্যবহার করে সংকীর্ণ রাজনৈতিক ফয়দা হাসিলের জন্য। সেই চক্রের কাছে এসব পড়ালেখা একেবারেই অপছন্দ।
সংশ্লিষ্টদের ইসলামি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময়ের প্রসঙ্গ তুলে কর্মশালায় শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা (বিতর্ক উত্থাপনকারীরা) তো সব সময় এলেম ও আলেম বলেন, এলেম অর্থ জ্ঞান বা বিজ্ঞান আর আলেম শব্দের অর্থ জ্ঞানী বা বিজ্ঞানী, তাহলে জ্ঞান-বিজ্ঞান যদি বাদ দিয়ে দেন তাহলে তো আর আলেম থাকেন না।’
কওমি মাদ্রাসা সূত্রে জানা গেছে, মা-লা-বুদ্দা মিনহু তাদের মূল কিতাব। এটি অপ্রাপ্ত বয়স্কদের সিলেবাসভুক্ত। এটিতে রয়েছে যৌনশিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়। এছাড়া বেহেস্তি জওরেও যৌনশিক্ষার বিষয় লেখা রয়েছে।
Leave a Reply