December 23, 2024, 2:27 am
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ছাত্রী হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা সত্য বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। একই সাথে হলের প্রভোষ্ট শামসুল আলম, হাউজ টিউটর মৌমিতা আক্তার ও ইশরাত জাহানসহ কয়েকজনের দায়িত্বে চরম অবহেলা পেয়েছে আদালতের নির্দেশে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। আর এ কমিটির কারন অনুসন্ধানে প্রক্টর শাহাদাত হোসেন উদাসীনতা ও দায়সারা গোছের বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এছাড়া ইবির দেশরতœ শেখ হাসিনা হলে ওই ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় ছাত্রলীগের সহ সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পৃথক তদন্ত কমিটি। যেখানে বলা হয়েছে নির্যাতনের ঘটনা পরিকল্পিত এবং মূল হোতা সানজিদা চৌধুরী।
বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে আজ মঙ্গলবার পৃথক দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন তুলে ধরেন ডেপুটি অ্যাটর্নি তুষার কান্তি রায়। প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর হাইকোর্ট আগামীকাল বুধবার আদেশের জন্য দিন রেখেছেন। পাশাপাশি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও আইনের অধীনে প্রনীত বিধি-প্রবিধানমালা সংগ্রহ করে তা দেখাতে এবং ইবির কোনো আইনজীবী থাকলে তাকে জানাতেও বলেছেন আদালত।
এর আগে ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরতœ শেখ হাসিনা হলের গণরুমে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ করেন ফিন্যান্স বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফুলপরী খাতুন। এ ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যুক্ত করে এবং জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা চেয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইবির সাবেক শিক্ষার্থী গাজী মো. মহসীন।
রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রুল দিয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন, নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং ওই নির্যাতনে জড়িত বলে ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী ও তাবাসসুম নামের যে দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে রাখাসহ কয়েক দফা নির্দেশ দেন।
তিন সদস্যের কমিটিতে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা, জেলা জজ মনোনীত বিচার বিভাগীয় একজন কর্মকর্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপককে রাখতে বলা হয়। কমিটি প্রতিবেদন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে আদালতে জমা দিতে বলা হয়। এ ছাড়া ওই ঘটনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত কমিটির প্রতিবেদনও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে আদালতে দাখিল করতে বলা হয়। এর ধারাবাহিকতায় আজ পৃথক প্রতিবেদন সীলগালা অবস্থায় আদালতে দাখিল করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। পরে আদালতে প্রতিবেদন দুটির অংশবিশেষে পড়ে শোনান তিনি। রিটের পক্ষে গাজী মো. মহসীন শুনানিতে ছিলেন।
ঘটনা পরিকল্পিত, নির্দেশদাতা সানজিদা/
বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী সানজিদা চৌধুরী ফুলপরীকে র্যাগিং, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নির্দেশদাতা এবং ওই পাশবিক, অমানবিক ও ন্যাক্করজনক ঘটনা সংঘটনে হুকুমদাতা। ওই অমানবিক, পাশবিক ও ন্যাক্করজনক জঘন্য ঘটনার সঙ্গে হালিমা আক্তার মুন্নী, ইশরাত জাহান মীম, তাবামসুম ইসলাম, ময়াবিয়া জাহান জড়িত এবং তাদের দ্বারা ঘটনাটি সংঘটিত হেেয়ছে। তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ফুলপরীকে পাশবিক কায়দায় অমানবিক ভাবে নির্যাতন করে।
ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসেছে। আর বলা হয়, সরাসরি নির্যাতন করে হালিমা আক্তার মুন্নী, ইশরাত জাহান মীম, তাবাসসুম ইসলাম ও ময়াবিয়া। তাবাসুমের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে প্রতীয়মান হয় যে, ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে দেশরতœ শেখ হাসিনা হলের ডাইনিংয়ে ফুলপরীর উপর পাশবিক নির্যাতনের সময় উর্মি ও মীম ভিডিও ধারন করে। তবে কোনো ভিডিও রেকর্ড পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া গনরুমে উপস্থিত ছাত্রীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আল আমিন কর্তৃক ফুলপরীকে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে।
প্রভোস্টদের গাফলতি, প্রক্টরের উদাসীনতা/
উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির ভাষ্য, তাবাসসুম ফুলপরীকে ৮ ফেব্রুয়ারি দেখা করতে বলে। ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে দেখা করে…..তাবাসসুম এটিকে বেয়াদবি হিসেবে মনে করে। এর কারনে তাবাসসুম ব্যক্তিগত ভাবে ফুলপরীর উপর রাগান্বিত হয়। এটিই তাবাসসুম প্রচার করে ফুলপরী সিনিয়রদের সঙ্গে বেয়াদবি করেছে। এ থেকে ঘটনার সূত্রপাত হয়।
তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, তাবাসুমের নেতৃত্বে ১০৫ নম্বর রুমে পিংকীর উপস্থিতিতে ফুলপরীকে ১১ ফেব্রুয়ারি রাত আটটায় অন্যান্য মেয়েদের উপস্থিতিতে গনরুমে হেনস্তা করা হয়। আজে বাজে কথা বলা হয়। পরবর্তীতে অন্তরার উপস্থিতিতে রাত নয়টার দিকে ৩০৬ রুমে (ফুলপরীর বক্তব্যে গনরুম) নিয়ে ফুলপরীকে মেয়েদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ গালিগালাজ এবং আজে বাজে কথা বলে মানসিক নির্যাতন করা হয়। এমনকি সেই রাতে ৩০৬ নম্বর রুমে থাকা মেয়েদের অন্তরা নির্দেশ দেয় ফুলপরীকে প্রত্যককে একটা একটা চড় মারতে। ফুলপরীর মোবাইল কেড়ে নয় লিমা ও তাবাসসুম। নির্যাতনের এক পর্যায়ে ফুলপরী অন্তরার পায়ে ধরতে বাধ্য হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফুলপরী মানসিক ভাবে ভেঙে পরে। অন্তরার নির্দেশে তাকে পাহারা দিয়ে রাখা হয়।
অন্তরার জোর জবরদস্তির কারনে প্রভোস্ট ফুলপরীকে হল ত্যাগ করার নির্দেশ দেন বলে তিন সদস্যের কমিটির প্রতিবেদনে এসেছে। বলা হয়েছে, এরপর প্রভোস্ট হলে উপস্থিত থাকা অবস্থাতেই অন্তরা, তাবাসসুম, মীম, উর্মি ও ময়াবিয়াসহ অন্যান্য মেয়েরা ফুলপরীকে হাত ধরে টানাটানি করে হেনস্থা করে। পরবর্তীতে ফুলপরীকে প্রভোস্ট শামসুল আলমের বরাবরে মুচলেখা দিতে বাধ্য হয়।
২০ ফেব্রুয়ারি ফুলপরীর জবানবন্দি গ্রহনের সময় তার মুখের বামগালে কালোদাগ দেখা যায় বলে প্রতিবেদনে এসেছে। প্রতিবেদনের ভাষ্য, হলের প্রভোস্ট শামসুল আলম, সহকারী রেজিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, শাখার কর্মকর্তা হামিদা খাতুন, আয়া, ডাইনিং ম্যানেজার সোহেল রানা, হাউজ টিউটর মৌমিতা আক্তার ও সহকারী অধ্যাপক ইশরাত জাহানের দায়িত্বে চরম অবহেলা ও ফুলপরী ইস্যুতে গাফলতি ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। এ ছাড়া প্রক্টর শাহাদাত হোসেনের উদাসীনতা ও দায়সারা গোছের বলে প্রতিবেদনে এসেছে।
রিট আবেদনটির ওপর আদেশের জন্য আগামীকাল দিন ধার্য করেছেন বেঞ্চ। হাইকোর্ট ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে আগামীকাল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি-বিধান উপস্থাপন করতে বলেছেন।
রিট আবেদনকারী অ্যাডভোকেট গাজী মো. মহসিন বলেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি ফুলপুরীর ওপর নির্যাতনের ঘটনা সত্য পেলেও এ ঘটনায় প্রক্টর, প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরের অবহেলার বিষয়ে কিছু বলেনি।
তদন্ত কমিটি তদন্তের প্রয়োাজন মনে করলে তাদের (সানজিদা ও তাবাসসুম) জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনকে (বিটিআরসি) বলা হয়েছে, কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেন এই ঘটনার কোনো ভিডিও আপলোড করা না হয়, সে বিষয়টি দেখতে।
এ ছাড়া, এই ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে তাদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট।
Leave a Reply