December 22, 2024, 2:16 pm
ড. আমানুর আমান এমফিল (আইইউ,কে), পিএইচডি (এনবিইউ-দার্জিলিং) সম্পাদক, দৈনিক কুষ্টিয়া ও দি কুষ্টিয়া টাইমস/
প্রধানমন্ত্রী ভারতে যাচ্ছন। সেখানে দ্ ুদেশের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক অনেকগুলো ইস্যু আলোচনায় আতে পারে। এগুলোর মধ্যে তিস্তা ইস্যু সবচে’ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নয়া দিল্লিতে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে বৃহস্পতিবার। দুই দেশে আন্তসীমান্ত নদী বিষয়ে পারস্পরিক স্বার্থ-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়া হিসেবে ১৯৭২ সালে এই যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়েছিল। এবার ছিল এই কমিশনের ৩৮তম বৈঠক।
বৈঠকে কমিশনের বৈঠকে অভিন্ন নদী বিশেষ করে গঙ্গা, তিস্তা, মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, দুধকুমার এবং কুশিয়ারা নদী সংক্রান্ত সব সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব নদীর পানি বণ্টন, বন্যার তথ্য আদান-প্রদান, নদী দূষণ মোকাবিলা, পলি ব্যবস্থাপনার ওপর যৌথ সমীক্ষা পরিচালনা, নদীর তীর রক্ষার কাজসহ পারস্পরিক স্বার্থ-সংক্রান্ত চলমান বেশ কিছু দ্বিপাক্ষিক বিষয় আলোচনায় উঠে এসেছে।
মন্ত্রী পর্যায়ের এই বৈঠকের আগে, মঙ্গলবার সচিব পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে জল সংক্রান্ত সব সমস্যা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়।
বৈঠকে উভয়পক্ষ কুশিয়ারা নদীর অন্তর্র্বতীকালীন পানিবণ্টন বিষয়ে সমঝোতা স্মারকের বিষয়বস্তু চূড়ান্ত করেছে। এই বিষয়ে ২০১৯ সালের অক্টোবরে স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ সমঝোতা স্মারক অনুসারে ত্রিপুরার সাবরুমম শহরের খাবার পানির চাহিদা মেটাতে ফেনী নদীর ওপর পানি ইনটেক পয়েন্টের নকশা এবং অবস্থান চূড়ান্তকরণকে স্বাগত জানায় দুই দেশ। বৈঠকে উভয় পক্ষই ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তির অধীনে বাংলাদেশের প্রাপ্ত পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করতে সম্মত হয়। এছাড়াও, বন্যা সংক্রান্ত তথ্য ও তথ্যের আদান-প্রদান, নদীর তীর রক্ষার কাজ, সাধারণ অববাহিকা ব্যবস্থাপনা এবং ভারতীয় নদী আন্তঃসংযোগ প্রকল্প নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
এসবই গতানুগতিক। বৈঠকে আলোচনার সবকিছু ছাপিয়ে আবারও যথারীতি উঠে এসেছে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি। চুক্তিটি দ্রæত সম্পন্ন করতে ভারতকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। ভারতও যথারীতিই আশ^াস দিয়েছে তারা চেষ্টা চালাবে।
আমাদের বিশ্লেষণ বলছে ভারতীয় জলশক্তি মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াতের বক্তব্য পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট বোঝা যায় ভারত আশ্বাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকও যথারীতি আশাবাদী ভাব নিয়েই কথা বলেছেন। আগেও সবাই তা করেছেন।
প্রশ্ন হলো চুক্তি বাস্তবায়নের ফলিত রুপায়ণ আদৌ কোথায়। কবে সমাধা হবে এ কাজটি। এই যে আশ^াসগুলো প্রতিবারই শেষ পর্যন্ত খেলায় পরিণত হয়ে আসছে। ভারত কি আদৌ তিস্তা চুক্তি করতে পারবে ? একটা ভাল দিক হলো কেউই আশা ছাড়তে রাজি নয়। অবশ্য দ্বিপাক্ষিক কুটনীতির বৈশিষ্টই এটি।
এশিয়ার দিকে তাকালে একটি বিষয় না বোঝার কিছু নেই সেটি হলো জল কেন্দ্রিক আগামীর ছড়ি থাকবে যে দুইটা দেশের হাতে, তার একটি চীন এবং অপরটি ভারত দেশ। আমেরিকান ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কমিশন ২০১৪ সালের তৈরি করা বৈশ্বিক প্রতিবেদনের ভাষ্য এমন।
মনমোহন সিং তার শাসনামলে নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে এক ভাষণে ‘ফাস্ট ট্র্যাক ডেভেলপমেন্ট’ কর্মসূচির কথা বলেছিলেন যেখানে উৎপাদন ও বিনিয়োগের জন্য বাঁধ নির্মাণ থেকে শুরু করে ভৌত পরিকাঠামো নির্মাণে উচ্চাভিলাসী ভিশনের কথা বলা হয়েছিল।
এই বাঁধ নিমার্ণের বিষয়টি ছিল উন্নতির উচ্চাভিলাস। কারন এটা করতে যেয়ে ভারত তার প্রতিবেশী দেশ চীন, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের সাথে আন্ত:নদী বিষয়ে বহুপাক্ষিক জটিলতার জালে জড়িয়ে পড়ে। সেই ৪৭ সাল থেকেই ভারত নদীতে বাঁধ দিয়ে কিংবা জলাধার নির্মাণ করে কোথাও বিদ্যুত উৎপাদন বাড়িয়েছে বা কোথাও চাষের জমির পরিমান বাড়িয়েছে। ফলদায়ী বাঁধগুলোকে ‘নতুন ভারতের মন্দির’ নাম দিয়ে একে সুরক্ষিত করতে চেয়েছিলেন নেহেরু। এগুলোও যে ভারতের জন্য সুষম উন্নয়ন বোধ তৈরি করেছে তা নয়। ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যেও এসব জল বন্টনের বিষয়ে দেখা দিয়েছে চরম মতানৈক্য ; চরম বিভেদ। এসবকে কেন্দ্র করেই এখন দিল্লীর সাউথ ব্লকের পররাষ্ট্রনীতির এক বিরাট অংশ দখল করে আছে পানিবণ্টন সংক্রান্ত কূটনীতি। ইদানিং বাংলাদেশের সাথে ভারতের তিস্তা চুক্তির প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে আবির্ভুত হয়েছে কেন্দ্রের সাউথ বøকের সাথে পশ্চিমবঙ্গের মহাকরণ (পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সচিবালয়) এর প্রাদেশিক কূটনীতি।
সেই ২০১১ সালের কথা তো ভুলে যাওয়ার নয়। মনমোহন সিং এর ঢাকা সফরেই তিস্তা চুক্তির প্রবল সম্ভাবনা থাকলেও পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারনে তা হয়নি। আরও দুঃখের বিষয় প্রণব মুখার্জী তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন মমতা বন্দোপ্যাধ্যায়। বাংলাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায়ে চূড়ান্ত তৎপরতার প্রেক্ষিতে মমতা প্রশাসন কল্যাণ রুদ্রকে নিয়ে একটি কমিটি করে দেন তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের আগের হোমওয়ার্ক হিসেবে। কেন্দ্রীয় জল কমিশনের কাছ থেকে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান না পাওয়ায় রিপোর্টে তিস্তার পানি-বণ্টন নিয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট সুপারিশই করতে পারেনি রুদ্র কমিটি। কল্যাণ রুদ্র কমিটির অসম্পূর্ণ রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে কতটা জল দেওয়া যায় তা নির্ধারণ করার আগে নদীর প্রবহমানতা, তিস্তায় পানির সঠিক পরিমাণ ও এদেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের বিষয়গুলো জানাটা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কেন্দ্রীয় জল কমিশন থেকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়া হয়নি। ফলে কমিটি কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। সুতরাং রুদ্র কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্ট যেমন সরকারের হাতে জমা পড়েনি, তেমনই রাজ্য সরকারও বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি ।
জোট ছাড়ার পর এখন সে দায় আর নিতে চাচ্ছেন না মমতা, যে কারণে তিস্তা চুক্তি প্রায় অনিশ্চিত। আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্কের নিয়ামক এখন প্রাদেশিক মূখ্যের ইচ্ছা ও দলীয় লাভালাভ।
ভারতের বাঙালি প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জীর সফরে সীমান্ত প্রটোকল ও তিস্তা চুক্তির প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৫-তে ‘ল্যান্ড বর্ডার বিল’ ভারতীর সংসদে পেশ ও পাশ করে বাঙালি প্রণবের আশ্বাস পূরণে সর্ব-ভারতীয় অবদান অভূতপূর্ব।
তিস্তা চুক্তি বাংলাদেশের জন্য যেমন জরুরি সেটা পশ্চিমবঙ্গের জন্যও জরুরি। এ নদীর অববাহিকায় দুই দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর বসবাস। তিস্তার ওপর নির্ভরশীল এ অঞ্চলের পরিবেশ ও প্রতিবেশ। যেহেতু তিস্তা দিয়ে সারা বছর সমান পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয় না। বাংলাদেশকে তিস্তার হিস্যা দেওয়ার আগে সিকিমের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের আলাদা করে সমঝোতা হওয়া দরকার বলে মনে করে রাজ্য সরকার। রাজ্যের অভিযোগ, গঙ্গা চুক্তির সময় বিহার বা উত্তর প্রদেশের সঙ্গে এ বোঝাপড়া না হওয়ায় তারা অনেক বেশি পানি টেনে নেয়। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে দিয়ে রাজ্যের জন্য আর যথেষ্ট প্রবাহ থাকে না। যে কারণে মরে যাচ্ছে হলদিয়া বন্দর। গঙ্গার ড্রেজিং বা সঙ্কোশ নদীর পানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে খাল কেটে গঙ্গায় এনে ফেলার যে প্রতিশ্রুতি কেন্দ্র দিয়েছিল তাও রাখা হয়নি।
তিস্তায় অভিন্ন অধিকার প্রশ্নে ২০১৪ সালের ১৭ আগস্টের আগের প্রেক্ষাপট এবং তার পরের প্রেক্ষাপটও এক নয়। ১৯৯৭ সালের ‘পানিপ্রবাহ কনভেনশন’ অনুযায়ী ৩৫টি দেশের অনুসমর্থনের ৯০ দিন পর তা আইনে পরিণত হওয়ার কথা। ২০১৪ সালের ১৯ মে ভিয়েতনাম ৩৫তম দেশ হিসেবে চুক্তিটি অনুসমর্থন করেছে। ফলে নিয়ম অনুযায়ী ১৭ আগস্ট থেকে সব অভিন্ন নদীতে আমাদের আইনি অধিকারও তৈরি হয়েছে। অবশ্য তিস্তার পানি চাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ কতখানি আন্তরিক, সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ চুক্তিটি অনুসমর্থন করেনি।
অন্যদিকে বহু স্তর বিশিষ্ট গণতন্ত্রের দেশ ভারতে আন্তঃদেশীয় চুক্তি সই করার আগে রাজ্য সরকারগুলোর মতামত যে গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমলে না নেওয়াতেও এ ধরনের সমস্যর উদ্ভব বলে মনে করেন অনেকে।
যদিও তিস্তা চুক্তি এখনও অনিষ্পন্ন। তারপরও দুইদেশের সৌহার্দ্যেরে আদান-প্রদান থেমে নেই। ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়মিত চর্চায় পরিণত হয়েছে। মমতার সাথেও সম্পর্কের কোন অবনতি নেই। তার সফরের সময় তিনি বলেছিলেন তিস্তা নিয়ে কোন কথা বলছেন না তবে আলোচনা চলতে সমস্যা নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আশ্বাস দিয়েছেন, সেটাকে কাজে রুপায়নের জন্য বাংলাদেশকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, ভারত বাংলাদেশকে পানি না দিলে ভারতের ক্ষতি নেই, ক্ষতি বাংলাদেশের। মমতা তার ভূ-ভাগগত রাজনীদির কারনে কোন কোন সময় নীরব থাকলেও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সব সময়ই তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়ে আশ্বাস দিয়ে আসছে। ২০১৩ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন, ‘তিস্তা সই হয়নি ঠিকই, কিন্তু তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহেও ভারত বাধা দেয়নি।’
বিশেষজ্ঞগণ মনে কছেন তিস্তার পানি পেতে বাংলাদেশকে আরও কূটনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। তারপরও যদি সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়, তাহলে অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে আইন প্রণীত হয়েছে, তার আলোকে হলেও আমাদের নদী অধিকার প্রতিষ্ঠায় আর্ন্তজাতিক আন্দোলনে যেতে বাধা নেই।
ব্যক্তি ব্যক্তিতে বন্ধুত্ব হলেও আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক কেবল এ সবের ভিত্তিতে হয় না। আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই রাষ্ট্রের স্বার্থই- কেন্দ্রীয় বিবেচনার বিষয়। তবে ভারত বাংলাদেশের আবহমান কালের সৌহার্দ্য এবং গত কয়েক বছরে ভারতের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশের অবদানের কথা বিবেচনায় নিয়ে তিস্তা চুক্তিতে সম্মত হলে দুই দেশের সম্পর্কে ভারসাম্য আসবে।
Leave a Reply