December 22, 2024, 8:31 pm
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
দেশে চলমান ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতার কারণে মানুষের দৃষ্টি এখন তেলের মজুত ইস্যুতে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চলছে মজুতের বিরাদ্ধে। উদ্ধার করা হচ্ছে হাজার হাজার লিটার তেল। ব্যবসায়ীদের প্রতি মানুষের সমালোচনা উঠছে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। কারন জনগনের এখন নাভিশ^াস। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন তারা নিয়ম মেনেই তেল মজুত করছেন। অনেকেই মজুতের বিবরণ প্রদর্শন করছেন। তবে হালে মোবাইল কোর্টের কাছে অনেক ব্যবসায়ী মজুত আইনের আওতায় যথাযথ নথি দেখাতে পারেন নি। এমনটাই মিডিয়াতে এসেছে।
এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, গুদামে তেল রাখা কি অবৈধ? যদি তাই হয়— তবে পাইকারি বিক্রেতারা তেল রাখবেন কোথায়, আর খুচরা বিক্রেতাদের কাছে সরবরাহই বা করবেন কীভাবে?
মজুত আইনে কী বলছে/
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুতদারি নিষিদ্ধ করে এই অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনের ২ (ঙ) ধারায় মজুতদারির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘মজুতদারি বলতে বোঝায়, কোনও আইন দ্বারা বা আইনের আওতায় কোনও ব্যক্তি মজুত বা গুদামজাত করার সর্বোচ্চ পরিমাণের বেশি দ্রব্য মজুত বা সংরক্ষণ করা।’
এ আইনের ২৫ (১) ধারার বিধানে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘কেউ মজুতদারি বা কালোবাজারে লেনদেনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তার আজীবন কারাদণ্ড বা ১৪ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। যদি প্রমাণ হয় যে, মজুতদার কোনও লাভের জন্য পণ্য মজুত করেনি, তাহলে ৩ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।’
এদিকে ইস্ট বেঙ্গল অ্যাক্ট-এর আওতায় অতি প্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের সরবরাহ, বিতরণ ও মজুত নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৫৩ সালে দ্য অ্যাসেনসিয়াল আর্টিকেলস (প্রাইস কন্ট্রোল অ্যান্ড এন্টি হোর্ডিং) অ্যাক্ট ১৯৫৩ শিরোনামে এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য’ বলতে দ্য কন্ট্রোল অব অ্যাসেনসিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট, ১৯৫৬-এর ধারা-২-এ উল্লিখিত পণ্যকে বোঝানো হয়েছে।
দ্য অ্যাসেনশিয়াল আর্টিকেলস (প্রাইস কন্ট্রোল অ্যান্ড এন্টি হোর্ডিং) অ্যাক্ট, ১৯৫৩-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ব্যবসায়ীরা সুবিধাজনক জায়গায় বা নিজেদের দোকান ও গুদামের সামনে পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য তালিকা প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য থাকবে। নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রয়ের তারিখ ও মেয়াদ সরকার নির্ধারণ করে দিতে পারবে।’
ধারা ৮-এ বলা হয়েছে, ‘কোনও ব্যবসায়ী সরকারের দেওয়া পূর্ব-কর্তৃত্ব ছাড়া কোনও ব্যক্তির কাছে কোনও অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বিক্রি আটকে রাখতে পারবে না বা বিক্রি করতে অস্বীকার করতে পারবে না। এ আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ১ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।’
প্রচলিত আইন/
প্রচলিত আইনে বলা হয়েছে, একজন পাইকারি বিক্রেতা সর্বোচ্চ ৩০ মেট্রিক টন পরিমাণ পাম ও সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ৩০ দিন মজুত রাখতে পারবেন। আর একজন খুচরা বিক্রেতা সর্বোচ্চ ৫ টন পরিমাণের পাম ও সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ২০ দিন মজুত করতে পারবেন। একইভাবে একজন আমদানিকারকও তার মোট আমদানিকৃত পাম বা সয়াবিন তেলের ২৫ ভাগ সর্বোচ্চ ৬০ দিন পর্যন্ত মজুত রাখতে পারবেন।
২০১১ সালের ৫ মে জারি করা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীণ সচিব বরুন দেব মিত্র স্বাক্ষরিত গেজেট (সরকারের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের এসআরও ১১৩ আইন-২০২২ (কন্ট্রোল অব কমোডিটিকস অ্যাক্ট-১৯৫৬) এর (২) ক (৪) ধারা বলে এ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
গেজেটের ২ এর ৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- এই আদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে চাল, গম, ও গমজাত দ্রব্যাদি ছাড়াও ভোজ্যতেল (সয়াবিন ও পামতেল) চিনি ও ডালকে খাদ্য সামগ্রী হিসেবে ঘোষণা করেছে।
সরকারের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের এসআরও ১১৩ আইন-২০২২ (কন্ট্রোল অব কমোডিটিকস অ্যাক্ট ১৯৫৬) (অ্যাক্ট নং ১ অব ১৯৫৬) এর সেকসন ৩ এর ক্ষমতাবলে সরকার মজুতের পরিমাণ ও মেয়াদ নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর শর্তাবলিতে বলা হয়েছে, ‘সরকার বা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত লাইসেন্স ব্যাতিরেকে কোনও ব্যবসায়ী এক মেট্রিক টনের অধিক খাদ্যশস্য বা খাদ্য সামগ্রী তার অধিকারে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না।’ খাদ্যশস্য বলতে এখানে ধান ও চালকে বোঝানো হয়েছে।
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে ব্যবসায়ীদের মজুতকৃত যে পরিমাণ সয়াবিন তেল ও পামরেতল উদ্ধার করা হচ্ছে সেক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য নয়। এর কারণ ব্যাখ্যা করে সূত্রটি বলছে, ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী মিল কর্তৃপক্ষ সরকারের অনুরোধে রমজান এবং ঈদের বিশেষ বাড়তি চাহিদা পূরণে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত ভোজ্যতেল সরবরাহ করেছে। যা কোনোভাবেই রোজার পরে বা ঈদের পরে বিক্রির উদ্দেশ্যে মজুত করতে পারবেন না। এসব ভোজ্যতেল সরবরাহ পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে বিক্রি করতে হবে।
সূত্রটি আরও বলছে, ব্যবসায়ীরা সেই বিশেষ বরাদ্দকৃত ভোজ্যতেল রমজানে এবং ঈদের সময় বিক্রি না করে বাড়তি মুনাফার লোভে মজুত করে রেখেছেন- যা শর্তের বরখেলাপ। এ কারণেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বাজারে অভিযান পরিচালনা করে ব্যবসায়ীদের লুকিয়ে রাখা ভোজ্যতেল উদ্ধার করছে। এবং উদ্ধারকৃত ভোজ্যতেল গায়ে লেখা দামে তাৎক্ষণিক উপস্থিত ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে।
ভিন্নতা রয়েছে চাল ও গমের ক্ষেত্রে/
অপরদিকে চাল ও গমের ক্ষেত্রে সরকারের মজুত আইনের নীতিমালায় এর ভিন্নতা রয়েছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী একপক্ষকালে (১৫ দিনে একপক্ষ) একটি রাইস মিল যে পরিমাণ ধান থেকে চাল প্রসেসিং করতে সক্ষম, ওই সময়ে মধ্যে উৎপাদন ক্ষমতার ৫ গুণ ধান এবং ২ গুণ চাল মিল মালিকরা মজুত রাখতে পারবেন। এই পরিমাণ ধান-চাল সর্বোচ্চ ৩০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। ৩০ দিনের বেশি মজুত রাখলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘বিদ্যমান মজুত নীতিমালা অনুযায়ী একটি মিলের এক পক্ষকালের ক্যাপাসিটির ৫ গুণ ধান ও ২ গুণ চাল মজুত রাখতে পারবেন। এই পরিমাণ ধান-চাল রাখতে পারবেন সর্বোচ্চ ৩০ দিন পর্যন্ত। এর চেয়ে পরিমাণে বেশি ধান-চাল রাখলে বা এই সময়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে মজুত রাখলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে।’ যেমন একটি মিলের এক পক্ষকালের ক্যাপাসিটি ১০ কেজি। ওই মিল কর্তৃপক্ষ এর ৫ গুণ অর্থাৎ ৫০ কেজি ধান এবং চাল ২ গুণ অর্থাৎ ২০ কেজি সর্বোচ্চ ৩০ দিন মজুত রাখতে পারবেন। এর বেশি হলেই তা অপরাধ।’
Leave a Reply