December 22, 2024, 9:17 pm
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার মধুপুরে কলার হাট কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক সেবায় সীমাহিন দূর্গতি সৃষ্টি করে চলেছে। যুগেরও বেশী সময় ধরে এই অবস্থা চললেও পরিস্থিতি নিরসনে কোন উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি। এই পরিস্থিতির সবথেকে বাজে শিকারে পরিণত হচ্ছে হাটের অদুরেই দক্ষিণ-পশ্চিমের সর্ববৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বলছেন এই হাটের কারনে প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১ ঘন্টার কর্ম-পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর জানিয়েছেন বিষয়টি নিয়ে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সাথে কথা বলা হবে।
সূত্র জানায় মধুপরের এ কলার হাটি একটি পুরাতন হাট। প্রতিদিন এটি বসলেও মৌসুমের এই সময়টিতে এ অঞ্চলে উৎপাদিত কলা নিয়ে হাটটি একটি বৃহৎ বাণিজ্যে পরিণত হয়। এ সময়ে হাটের জন্য নির্ধারিত জায়গার বাইরে গিয়ে এটি মহাসড়ক জুড়ে প্রসারিত হয়ে যায়। কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে মহাসড়ক জুড়ে ভ্যান, নসিমন, করিমন, আলগামন এবং বড় বড় ট্রাক লোড-অনলোডে ব্যবহার করা হয়। এর ফলে মহাসড়কে যানজট অবশ্যম্ভাবী একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিদিন। এ যানজট সকাল থেকে শরু হয়ে অব্যাহত থাকে যতক্ষণ হাটে কলা থাকে ও বেচাকেনা চলে ততক্ষণ।
এ সংক্রান্ত আইন বলছে, মহাসড়কের ওপর বা নিয়ন্ত্রণ রেখার মধ্যে হাটবাজারসহ কোনো ধরনের ¯’াপনা নির্মাণের সুযোগ নেই। ২০২১ সালের মহাসড়ক আইনে এ বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। মহাসড়কের নিয়ন্ত্রণ রেখার মধ্যে হাটবাজার স্থাপনে বিধিনিষেধ ছিল ১৯২৫ সালের হাইওয়ে অ্যাক্টেও। কিন্ত এসব বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে মহাসড়কের ওপর এবং নিয়ন্ত্রণ রেখার মধ্যে গড়ে উঠেছে এ হাটটি।
এ হাট নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে কথা বলা হলেও কার্যকর কোন পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। বরং দিন দিন হাটের পরিসর বাড়ছে। বাড়ছে দুর্ভোগ।
এ মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনের চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ হাটের কারনে কখনও কখনও তাদের আধাঘন্টা থেকে ঘন্টা ব্যাপী সময় নষ্ট হয়ে যায়। কুষ্টিয়া থেকে খুলনা গামী গড়াই পরিবহনের চালক রুহুল কুদ্দস জানান নষ্ট হয়ে যাওয়া সময় কভার করতে প্রায়ই তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গতি বাড়িয়ে গাড়ি চালাতে হয়। এটা এই মহাসড়কে দূর্ঘটনা প্রবনতা বৃদ্ধির একটি বড় কারন।
সম্প্রতি সড়কের এই মধুপুর পয়েন্টে ডাবল ওয়ে করা হয়েছে। রাস্তার পরিসর বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিš‘ অব¯’ার উন্নতি হয়নি। বরং দেখা যাচ্ছে, প্রসারিত সড়কে হাটের বিস্তৃতি ঘটেছে।
এই হাটের সবথেকে বাজে শিকারে পরিণত হচ্ছে হাটের অদুরেই থাকা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের একটি বড় অংশ নির্বাহ হয়ে থাকে কুষ্টিয়া থেকে পরিবহনে প্রতিদিন আসা শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে।
সূত্র জানায় প্রতিদিন বিশ^^বিদ্যালয়ের প্রায় ৬০ থেকে ৬৫টি গাড়ি চারবার এসকল শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে ট্রিপ ভিত্তিক আসা যাওয়া করে। এর বাইরেও অসংখ্য পরিবহন যাতায়াত করে। এসব গাড়িগুলো বিশ^বিদ্যালয়ে প্রবেশের একটু আগে ও বিশ^বিদ্যাালয় থেকে বেড়িয়েই এই কলার হাটে যানজটে যায়।
অসংখ্য শিক্ষার্থী দৈনিক কুষ্টিয়াকে জানান তাদের ক্লাস বিলম্বিত হ”েছ প্রতিদিনই। অনেক সময় পরীক্ষায় অংশগ্রহনে তাদের পিছিয়ে পড়তে হয়।
একটি বিভাগের একজন শিক্ষক জানালেন কখনও কখনও এ সমস্যা সীমাহিন হয়ে উঠে। অনেক সময় ক্লাস ড্রপ আউট হয়ে যায়।
বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান প্রতিদিন এই হাটের কারনে তাদেরকে কোন না কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। আর অব্যাহতভাবে চলে আসা একটি সমস্যার সমাধান কেন হয় না এটা সত্যিই একটি বড় প্রশ্ন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনের সাথে কথা বলা হবে। প্রয়োজনে লিখিত দেয়া হবে।
বাংলাদেশ হাইওয়ে পুলিশের তথ্য বলছে, দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স্থায়ী ও অস্থায়ী হাট বাজারের সংখ্যা ২৫৬। এসব হাটবাজারে আসা ছোট ছোট যানবাহন ও পণ্যবাহী যানবাহনের কারণে তীব্র আকার ধারণ করছে যানজট। মাঝেমধ্যেই ঘটছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহাসড়কের পাশে হাটবাজার বা কোনো স্থাপনা নির্মাণ করলে সেখানে স্থানীয় যানবাহনের একটা চাপ তৈরি হয়। মহাসড়কের ওপর দিয়ে কিংবা আশপাশে মানুষের চলাচলও বেড়ে যায়। স্থানীয় যানবাহন ও হাটবাজারে আসা মানুষের কারণে মহাসড়কে চলা যানবাহনের একটা সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়। ফলে যানজট, বিশৃঙ্খলা, দুর্ঘটনার মতো ঘটনা ঘটে। বিশ্বব্যাপী মহাসড়কের যে মানদণ্ড, তার সঙ্গে এসব হাটবাজার কোনোভাবেই যায় না বলে জানিয়েছেন তারা।
মহাসড়কের ওপর হাটবাজার গড়ে তোলার এ সমস্যা দীর্ঘদিনের বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, সড়ক-মহাসড়কের মতো অবকাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনায় সবার আগে অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা ভূমি ব্যবস্থাপনা না। কিন্তু দেশে যারা সড়ক-মহাসড়ক তৈরির দায়িত্বে আছেন, তারা কখনই বিষয়টি পরিকল্পনার মধ্যে রাখেননি। পৃথিবীর কোথাও মহাসড়কের ধারেকাছে হাটবাজার তো দূরের কথা, কোনো আবাসিক এলাকাও থাকে না। ভূমি ব্যব¯’াপনাটি আমাদের পরিকল্পনার সঙ্গে কখনই সমন্বিতভাবে করা হয়নি। মহাসড়কের ওপর এবং আশপাশে গড়ে ওঠা হাটবাজারগুলো দ্র“ত অপসারণের পাশাপাশি ভবিষ্যতে সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে সমন্বিতভাবে ভূমি পরিকল্পনা গ্রহণের বিষয়টিতে গুর“ত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
দেশের মহাসড়কের ওপর গড়ে তোলা হাটবাজারের কারণে সৃষ্ট জটিলতার বিষয়গুলো সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগে অনুষ্ঠিত এক সভায় তুলে ধরেন হাইওয়ে পুলিশ হেড কোয়ার্টারের এসপি মোস্তাফিজুর রহমান। সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ বাস্তবায়ন শীর্ষক ওই সভায় তিনি জানান, হাইওয়ে পুলিশ কর্তৃক দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৫৬টি স্থায়ী ও অস্থায়ী হাটবাজার শনাক্ত করা হয়েছে, যেগুলো মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। হাটবাজারগুলোয় আসা ইঞ্জিনচালিত নসিমন, করিমন ও পণ্যবাহী বিভিন্ন যানবাহনের কারণে মহাসড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। মাঝে মাঝে দুর্ঘটনাও ঘটে।
মহাসড়কে হাটবাজারের এসব বিষয় সম্পর্কে জানতে গতকাল যোগাযোগ করা হলে হাইওয়ে পুলিশ হেড কোয়ার্টারের এসপি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, হাটবাজারগুলো ইজারা দেয়া হয়েছে মহাসড়ক থেকে ২০০-৩০০ ফুট দূরে বসানোর শর্তে। কিš‘ বাস্তবে দেখা যায়, এসব হাটবাজার ক্রমেই মহাসড়কের কাছে চলে আসে। আবার কোথাও কোথাও দেখা গেছে, হাটবাজারগুলো মহাসড়ক থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্বে স্থাপনের জন্য ইজারা নিলেও সেগুলো বসানো হয় মহাসড়কের সংরক্ষণ রেখার মধ্যে।
মহাসড়কের নিয়ন্ত্রণ রেখা কতটুকু তা স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে ২০২১ সালের মহাসড়ক আইনে। আইনটির সংজ্ঞায় সংরক্ষণ রেখা সম্পর্কে বলা হয়েছে, মহাসড়কের দুই পাশের ভূমির প্রান্তসীমা থেকে ১০ মিটার বা সরকার কর্তৃক গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নির্ধারিত রেখা। অন্যদিকে মহাসড়ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ সম্পর্কিত একটি উপধারায় বলা হয়েছে, সরকারের পূর্বানুমোদন ব্যতীত মহাসড়কের সংরক্ষণ রেখার মধ্যে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ, হাটবাজার বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে মহাসড়কের কোনো অংশ ব্যবহার করা যাবে না।
মহাসড়কের ওপর অবৈধভাবে গড়ে ওঠা হাটবাজার অপসারণে পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়েছেন সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী একেএম মনির হোসেন পাঠান। তিনি বলেন, মহাসড়কের সংরক্ষণ রেখার মধ্যে কোনো ধরনের স্থাপনা তৈরির নিয়ম নেই। তার পরও দেশের বিভিন্ন স্থানে মহাসড়কের সংরক্ষণ রেখার মধ্যে হাটবাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলো অপসারণে আইন অনুযায়ী আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।
Leave a Reply