November 11, 2024, 5:38 am
শুভব্রত আমান/
নির্মাণ আযূস্কাল শেষ হওয়ার আগেই কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়কের যশোর ও ঝিনাইদহ অংশের ৫৪ কিলোমিটার নষ্ট হয়ে গেছে। এর মধ্যে এই দুই জেলায় ১৭ কিলোমিটার সড়ক এখন মরণফাঁদ ও চরম দুর্ভোগের কারণ। যার মধ্যে রয়েছে যশোরে ৫ কিলোমিটার এবং ঝিনাইদহ অংশে ১২ কিলোমিটার।
এই কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ছিল ৩২১ কোটি টাকা। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। একদফা অতিরিক্ত ২৭ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে কাজ শেষ হয় ২০২২ সালে। খরচ হয় ৩৪৮ কোটি টাকা।
প্রায় ১৬৮ কিলোমিটারের এই কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক ভৌগলিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ; উত্তরঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনকারী একমাত্র মহাসড়। প্রতিদিনই এ সড়কে দিয়ে খুলনা, ঢাকা, কুষ্টিয়াসহ আঞ্চলিক রুটের হাজার হাজার বাস-ট্রাক চলাচল করে। খুলনা, কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চল বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ায় খুলনা ও কুষ্টিয়া এবং যশোর অঞ্চল নিয়ে গঠিত এই বিভাগ কে শিল্প ইন্ডাস্ট্রির বিভাগ হিসেবে ডাকা হয়। বিভাগে রয়েছে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মোংলা বন্দর। দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বন্দর খুলনা বিভাগের যশোরে অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রথম রেলপথ এবং এশিয়ার সর্ববৃহৎ চিনিকল কেররু এন্ড কোম্পানি খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গা জেলাতে অবস্থিত। এছাড়া কুষ্টিয়ায় রয়েছে ভারী শিল্পাঞ্চল।
মহাসড়কটির নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন জেলার সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ।
এ প্রতিষ্ঠানের যশোর ও ঝিনাইদহ জেলা অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে এই ১৬৮ কিলোমিটার মহাসড়ক সংস্কার, পূণ-সংষ্কার ও পূর্ণ-নিমার্ণের আওতায় বরাদ্দ পায় প্রায় ১৪০০ কোটি টাকা। বিভিন্ন জেলা অফিস স্ব স্ব জেলায় এই কাজ বাস্তবায়ন করে। মহাসড়ক গঠনের কাজ এখনও কোন কোন জেলায় চলমান।
যশোরের পালবাড়ী মোড় থেকে ঝিনাইদহের পাগলা কানাই পর্যন্ত বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। যশোর-খুলনা সড়কের মণিহার মোড় থেকে নওয়াপাড়া রাজঘাট পর্যন্ত পুরোটাতেই খানাখন্দ। যে কারণে মত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটি।
যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্র বলেছে, যশোর-খুলনা মহাসড়কের যশোর শহরের পালবাড়ী মোড় থেকে অভয়নগরের রাজঘাট পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণকাজের অনুমোদন মেলে ২০১৭ সালে। টেন্ডারসহ সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের মে মাসে। এর মধ্যে পদ্মবিলা, রাজঘাট হয়ে চেঙ্গুটিয়া পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটারের কাজ পায় ‘তমা কনস্ট্রাকশন’। বাকি ১৯ কিলোমিটারের কাজ পায় ‘মাহবুব ব্রাদার্স’। দুটি প্যাকেজে মোট ৩২১ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে।
সূত্র বলেছে, কার্যতালিকা অনুযায়ী সড়কটির আয়ুষ্কাল ছিল তিন বছর। কিন্তু করোনা ও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ করা হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বর। বর্ধিত সে সময়েও কাজ শেষ হয়নি। পরে আবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এতে ব্যয় ২৭ কোটি টাকা বেড়ে হয় ৩৪৮ কোটি টাকা। কিন্তু সড়কটি সওজকে বুঝিয়ে দেওয়ার এক মাসের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে। প্রকৌশলের ভাষায় এ সমস্যাকে ‘রাটিং’ বলে। এক বছরের মধ্যে সড়কের প্রায় ১৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রাটিংয়ের কারণে সৃষ্টি হয় নানা গর্ত।
সড়ক ও জনপথের তথ্যমতে, মহাসড়কের রাটিং সংস্কারের জন্য পিচের রাস্তার ওপর কংক্রিট রাস্তা নির্মাণে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে গত জুনে প্রস্তাব পাঠায় সওজ। ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ১৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ কিলোমিটার রাস্তা প্রথম পর্যায়ে কংক্রিট বা ঢালাই রাস্তা করার জন্য নির্দেশনা পায় সওজ। এখন সেই কাজ চলছে। কাজ করছে সেই ‘মাহবুব ব্রাদার্স’ ও ‘তমা কনস্ট্রাকশন’ই।
এর আগে সড়কের কাজের শুরুতেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসীর অভিযোগ ছিল সড়ক উন্নয়নের কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোনো নিয়মনীতি মানেনি। ঠিকাদারেরা সড়কের পুরোনো নোনা ধরা ইট-খোয়া তুলে সেটাই আবার ভেঙে গর্তে ব্যবহার করেছেন। এ ছাড়া সড়কটি ৫ ফুট গর্ত করে ভিত তৈরির নির্দেশনা থাকলেও সেই নিয়মও মানেনি। সড়কে নতুন ইট, বালু, খোয়া ব্যবহার না করে খুঁড়ে ওঠানো মালামাল দিয়েই ফের ভরাট করা হয়েছে।
তমা কনস্ট্রাকশন’-এর সাব-ঠিকাদার সৈয়দ তরিকুল ইসলাম কোন অভিযোগকেই আমলে অনেননি। তিনি বলেন, কাজের মান নিয়ে সড়ক বিভাগ ও বুয়েট কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেনি। তিনি মহাসড়কে ওভারলোডিংয়ের (অতিরিক্ত ভারী যানবাহন চলাচল) কারণে সড়কের এই অবস্থা বলে নিজেই অভিযোগ তুলেন।’ তিনি বলেন, ‘সড়কের যে স্থানে রাটিং সৃষ্টি হয়েছে; সেখানে নতুন করে বরাদ্দ হওয়া ঢালাইয়ের কাজও তারাই করছেন।’
একটি সূত্র জানাচ্ছে, করোনাকালীন সড়কের কাজে দেশের বাইওে থেকে ভাল মানের পিচ আনতে সমস্যঅ হয়েছে। ঐ সময়ে বাংলাদেশের সকল পিচ চিপস ভারত থেকে আনতে হয়। এগুলোর মান ভাল ছিল না।
যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া ‘রাস্তার দূর্দশার দায় সবার বলে জানান। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যারা সড়ক ব্যবহার করেন তাদের কতজন নিয়ম মানেন ? তিনি বলেন, ওভারলোডের কারণে সড়কটির এই অবস্থা।
এই কর্মকর্তা বলেন, নতুন বরাদ্দে, এই সড়কটির রাটিং হওয়ার পরে বুয়েট এবং সড়ক ও জনপদ বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী ১৬ কিলোমিটার রাস্তা ঢালাই করা হবে। ইতিমধ্যে প্রথম ধাপে ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ কিলোমিটারের কাজ শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, ঢালাই করা শেষ হলে সড়কে যাতায়াতে সমস্যা হবে না বলে আশা করছি।’
Leave a Reply