একটি দৈনিক কুষ্টিয়া প্রতিবেদন/
বাংলাদেশের বিচার অঙ্গণের এক আইকন (আইনজীবী ও বিচারক উভয় হিসেবেই) হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের প্রতিটি বিন্দুতেই তিনি ছিলেন নির্মোহ, সৎ, নিষ্ঠা ও স্বচ্ছতার প্রতীক। বাংলাদেশের সরকার তাকে একজন আইনজীবী থেকে সবোর্চ্চ আদালতে বিচারক পরবর্তীতে দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন। এখানে তাঁর মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা, নিষ্ঠা প্রধান্য পেয়েছিল। তাঁকে নিয়ে ষড়যন্ত্রও হয়েছিল, কিন্তু তা কাজে আসেনি। আইন ও বিচারালয়ের উন্নয়নে তিনি নিরলসভাবে কাজ করেছেন এবং তিনি ঠিকই তাঁর প্রাপ্য সম্মান নিয়ে শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। এখানে তাঁর সফলতা ছিল প্রশ্নাতীত।
অবসরে গিয়েও তিনি সর্বোচ্চ বিচারালয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইনগত বিষয়ে অনেকভাবে মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তার মানে হলো তাঁর যে কাজ করবার যোগ্যতা অব্যাহতই রয়ে গিয়েছিল। এই রকম একজন মানুষকে সদাশয় সরকার যোগ্য বিচেনায় নতুন কোন পদে পদায়নের চিন্তা থেকেই তাঁকে জুডিশিয়াল ট্রেইনিং ইন্সটিটিউটে মহাপরিচালক পদে প্রধান বিচারপতির সম-মর্যাদা দিয়ে নিয়োগ দেন। এখানে অন্যকোন বিষয় একবারেই ছিল বলে মনে হয় না। শুধু ছিল একজন মানুষের মেধা ও দক্ষতাকে আরো অধিকতরভাবে কাজে লাগানো।
এ বিষয় নিয়ে মহল বিশেষ থেকে কিছু কথা উঠছে। আমরা ঐসব মহলের তুলে ধরা কথাগুলো মূল্যবান বিবেচনা করে এ বিষয়ে সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদারের কথাগুলো তুলে ধরতে চাই।
তিনি যা লিখেছেন ঃ সাম্প্রতিক পাওয়া দুর্নীতির চিত্র এবং বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে নিয়ে আলোচনা সে রকমই মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে প্রভাবশালী গোয়েন্দা ও জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার নাম ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)।
এফবিআই’র প্রধান নির্বাহীর পদ “পরিচালক”। এফবিআই হলো বিচার মন্ত্রণালয়ের একটি সংস্থা। এফবিআই’র পরিচালক, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে রিপোর্ট করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল পদাধিকার বলে যুক্তরাষ্ট্রের আইন/ বিচার মন্ত্রীও। ফেডারেল জেলা আদালতের প্রধান বিচারক (চীফ জাজ অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস ডিস্ট্রিক্ট ফর দ্য ওয়েস্টার্ণ ডিস্ট্রিক্ট অব টেকসাস বিল সেশনস ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এফবিআই’র এর পরিচালক ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ২৭ তম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হাওয়ার্ড ট্যাফট ১৯০৯ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পরে ১৯২১ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় মর্যাদাক্রমে প্রেসিডেন্ট এক নম্বরে এবং প্রধান বিচারপতি পাঁচ নম্বরে। এতে কোন অসুবিধা হয় নি। কেউ মর্ষাদাক্রম অথবা উইলিয়াম হাওয়ার্ড ট্যাফট এর নিয়োগ অথবা নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি।
অষ্ট্রেলিয়ার প্রথম প্রধান মন্ত্রী (সরকার প্রধান) এডমন্ড বার্টন ১৯০১ থেকে ১৯০৩ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার জাতির পিতাদের একজন হিসেবে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়। ১৯০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়া ফেডারেশনের সর্বোচ্চ আদালতের নাম হাইকোর্ট এবং স্টেট বা অঙ্গরাজ্য সমূহের সর্বোচ্চ আদালতের নাম সুপ্রিম কোর্ট। এডমন্ড বার্টন ১৯০৩ সালে স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী তথা প্রধান মন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন এবং সানন্দে হাইকোর্টের একজন বিচারপতি (প্রধান বিচারপতি নয়) হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯০৩ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল হাই কোর্টের বিচারপতি ছিলেন।
অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রীয় মর্যাদাক্রমে প্রধান মন্ত্রীর অবস্থান চার নম্বরে। হাইকোর্টের একজন বিচারপতির অবস্থান ১৩ নম্বরে। কিন্তু কেউ বার্টনের মর্যাদাক্রম বা নিরপেক্ষতা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেননি অথবা রাষ্ট্রের স্থপতিদের একজন হিসেবে তাঁর সম্মানও কমেনি।
শিক্ষকতা, দূতিয়ালি ও বিচারকের চাকরির রাষ্ট্রীয় মর্যাদাক্রম গৌন। এখানে ব্যক্তির ইমেজ ও অবদানই মুখ্য। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের চেয়ে অনেক সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু তিনি ক্লিনটনের দূত হিসেবে নানা দেশে গেছেন। একইভাবে ক্লিনটনও ওবামার দূতিগিরি করেছেন। তবে হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের দূতিগিরি এ তালিকায় আসবে না। সেখানে প্রেক্ষিত ভিন্ন ছিল।
পৃথিবীর নামি-দামি রাষ্ট্র নায়করা অবসর জীবনে শিক্ষকতা করেছেন। বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী অবসর গ্রহণের পর জুডিশিয়াল ট্রেইনিং ইন্সটিটিউটের (জেটিআই) এর মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করেছেন। এটি শিক্ষকতার পদ। শিক্ষকতা পেশার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা গৌন। এ পেশায় সামাজিক মর্যাদাই মুখ্য। একজন শিক্ষক ছাত্র -ছাত্রীদের কাছে যে ভালোবাসা ও সম্মান পান, সেটা যে কোন মর্যাদাক্রমের অনেক উপরে। প্রশিক্ষণার্থী/ শিক্ষার্থীরা একজন ভালো শিক্ষকের কাছে যা শেখেন সেটা মহামূল্যবান।
আমি বাংলাদেশের ষোলোতম প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিনের শিক্ষা নবিস। তবে তিনি তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন না। তিনি তখন কিশোরগঞ্জ জেলার জেলা ও দায়রা জজ। আমি তখন শিক্ষা নবিস ম্যাজিস্ট্রেট। আমি এজলাসে তাঁর পাশে বসে মামলার কার্যক্রম শিখেছি। তখন তাঁর মতো একজন উঁচুমানের সৎ, সজ্জন ও জ্ঞানী মানুষের সাহচর্য পেয়ে উজ্জীবিত হয়েছি। পরে তিনি প্রধান বিচারপতি হন। তাঁর এ পদে আসীন হবার পর অতীতের স্মৃতি স্মরণ করে নিজেকে সম্মানিত বোধ করি ও নতুন করে অনুপ্রাণিত হই। উল্লেখ্য, তিনি একমাত্র ব্যক্তি, যিনি মুন্সেফ হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করে প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত উঠতে সক্ষম হন।
আমি তো মনে করি, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী জেটিআই এর মহাপরিচালক -এর পদ গ্রহণে সম্মত হয়ে দেশবাসীকে ঋণী করেছেন। সরকারও তাঁকে নিয়োগ দিয়ে ভালো কাজ করেছে। সরকার দেশের নবীন বিচারকদেরকে এক বটবৃক্ষের (অভিজ্ঞতা ও সাবেক পদবির বিবেচনায়) ছায়ায় পেশাদারিত্বের শিক্ষা ও দীক্ষা নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এতে নবীন অফিসাররা অনেক উজ্জীবিত ও উপকৃত হবেন।
প্রশিক্ষণে অ্যাকাডেমিক জ্ঞানের চেয়ে মিথস্ক্রিয়া ও অভিজ্ঞতা বিনিময় ও অর্জনের বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এ কাজে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি অপেক্ষা অধিক যোগ্য কাউকে পাওয়া কী সম্ভব ! আর জেটিআই - এর মহাপরিচালক – এর পদটি লাভজনক পদ নয়। এটি অবদান রাখার, আলো ছড়ানোর পদ। এখানে তিনি যে কয়টাকা বেতন-ভাতা
নেবেন, সেটা নগণ্য। তিনি ভবিষ্যতের বড়ো বড়ো বিচারকদের সঙ্গ ও দীক্ষা দেবেন, তৈরি করবেন, এটা মহামূল্যবান। এটাকে সুযোগ হিসেবে, আশার আলো হিসেবে দেখাই বাঞ্ছনীয়। কোন উচ্চ পদধারীর এমন পদ গ্রহণকে তাঁর উদারতা ও ত্যাগ হিসেবে দেখাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।
আমাদের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো অবহেলিত। এখন ওইসব জায়গায় যাওয়ার মতো নিবেদিত মানুষ তেমন একটা পাওয়া যায় না। নিবিড় প্রশিক্ষণ ছাড়া ভালো বিচারক অথবা অফিসার কোনটাই তৈরি করা সম্ভব নয়। নবীন বিচারকদের মধ্যে সদিচ্ছা, সততা ও সাহস সঞ্চার করা অপরিহার্য। প্রধান বিচারপতির অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন মানুষ এ ক্ষেত্রে সহজেই ইতিবাচক অবদান রাখতে পারেন।
আইসিএসদের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল হেইলিবারি কলেজ। যুক্তরাজ্যের কেবিনেট সেক্রেটারি অনেক ক্ষমতাধর মানুষ। কিন্তু তাঁকে নিয়ে কমই আলোচনা করা হয়। কিন্তু সিভিল সার্ভিস বিষয়ক গবেষণা ও আলোচনায় হেইলিবারি কলেজের অধ্যক্ষদের এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
খালেদ শামস ১৯৬৪ ব্যাচের সিএসপি অফিসার। উনার ব্যাচে পুরো পাকিস্তানে প্রথম হন। তিনি বাংলাদেশ সিভিল অফিসারস একাডেমি ( কোটার) প্রথম অধ্যক্ষ। তিনি কোটাকে এমন মানে পরিচালনা করেন যে, তাঁকে বাংলাদেশের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের
জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর ক্যারিয়ারের এ অংশটুকু সবচেয়ে দীপ্তিমান। তাঁর প্রশিক্ষণার্থীরা
তাঁকে গুরু ডাকেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা দিয়ে জেটিআইকে সেন্টার এক্্িরলেন্স হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারেন। তবে এমনটি ঘটাতে হলে ন্যূনতম ৪/৫ বছর সময় দরকার। খালেদ শামস কোটায় ৫ বছর ছিলেন। তাই তিনি কোটাকে সেন্টার এক্্িরলেন্স এর পর্যায়ে নিতে সক্ষম হন। লন্ডনের হেইলিবারি কলেজের অধ্যক্ষ ড. যোশেফ হ্যালেট ব্যাটেন ২৩ বছর এবং ড. হেনরি মেলভিল ১৫ বছর অধ্যক্ষ ছিলেন। তাই তাঁরা ভালো কিছু করতে পেরেছিলেন। শুধু নিয়োগ দিলেই হয় না, ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য যৌক্তিক সময়ও দিতে হয়। তাই সরকার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর চুক্তির মেয়াদ ন্যূনতম চার বছর করতে পারে।
উগান্ডার প্রথম প্রধান মন্ত্রী ছিলেন বেনেডিক্ট কাউয়ানকা। ১৯৬২ সালে মিল্টন ওবোতোকে তাঁকে ক্ষমতাচ্যূত করেন। ১৯৭১ সালে ইদি আমিন মিল্টন ওবোতোকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। অত:পর ইদি আমিন সাবেক প্রধান মন্ত্রী বেনেডিক্ট কাউয়ানকাকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেন। নিয়োগ পাবার পর তিনি ইদি আমিনের নির্দেশ মতো বিচার কাজ পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানান। তাই ১৯৭২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইদি আমিন তাঁকে গুলি করে হত্যা করেন।
শুধু নিয়োগ দিলেই হয় না। নিয়োগ দিতে হয় সততা, সুনাম ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। কাজ করতে দিতে হয় স্বাধীনভাবে। যিনি নিয়োগ পান, তাঁর থাকতে হয়, সদিচ্ছা, সততা, সাহস, জ্ঞান ও কর্মযোগী মনোভাব। এগুলোর সমন্বয় ঘটলে যে কোন প্রতিষ্ঠান সেন্টার এক্্িরলেন্স হতে বাধ্য।
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী অন্য কোন পেশায় যোগ দিলে আমি সমর্থন করতাম না। আমি তাঁর অভিজ্ঞতা শিক্ষার কাজে লাগানোকে ইতিবাচক হিসাবে দেখি। তবে আমি যে কোন ভিন্নমতকে সম্মান জানাই। সামাজিক বিজ্ঞানে ভিন্নমত অনিবার্য।
একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার
সাবেক সচিব, লেখক, গবেষক, মুক্তিযোদ্ধা
শহীদ পরিবারের সদস্য এবং
সাবেক রেক্টর, বিপিএটিসি।
২০.০৬.২০২৪
সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর : ড. আমানুর আমান,এম.ফিল (আইইউকে), পিএইচডি ( এনবিইউ- দার্জিলিং)
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: শাহনাজ আমান।
কার্যালয়:- থানা ট্রাফিক মোড়, কুষ্টিয়া।মোবাইল- ০১৭১৩-৯১৪৫৭০, ইমেইল: info.dailykushtia@gmail.com
ই-পেপার কপি