ড. আমানুর আমান, সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক কুষ্টিয়া ও দি কুষ্টিয়া টাইমস/
আজ ১৭ এপ্রিল, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস নামে পরিচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য এ দিনটি ; সেদিন নির্বাচিত ১৬৭ জন এমএনএ এবং ২৯৩ এমপি একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করছিলেন। তাদের নেতৃত্বেরই এইদিনেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং এ সরকারের ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়। অন্যদিকে, একটি স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে জাতিয়-আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টি ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় এবং বাংলাদেশের জনগণকে তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্ল¬বী কার্যক্রমের মাধ্যমে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে অদম্য স্পৃহায় মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এই সরকার গঠনের ফলে বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামরত বাঙালিদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত হয়। সর্বোপরি, ৯ মাস যুদ্ধের পর এই মুজিবনগর সরকারের হাত ধরেই ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকারের গুরুত্ব ও অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে এবং চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
বলা হয়ে থাকে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যায়। এর প্রায় ২০০ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুরের মুজিবনগর আম্রকাননে স্বগর্বে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্য।
প্রেক্ষাপট/
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ম্যান্ডেট দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞে নেমে পড়ে বাংলার আনাচে-কানাচে। বন্দী করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। দেশজুড়ে শুরু হয় স্বাধীনতাকামী জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধ ; মুক্তির যুদ্ধ। কিন্তু এ যুদ্ধের বৈধতা প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা, অস্ত্র সুরক্ষা এবং প্রশিক্ষণ। প্রয়োজন ছিল কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করা।
অন্যদিকে, একটি যুদ্ধরত বাংলা ভূখন্ডে একটি বৈধ স্বাধীন সরকার গঠন করতে প্রয়োজন ছিল একটি মুক্তাঞ্চল। এ লক্ষ্যে তৎকালীন কুষ্টিয়া অঞ্চলকে ঘিরে শুরু হয় পরিকল্পনা।
কুষ্টিয়ার মাটিতেই ১৯৭১ সালের ০৩ মার্চ প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। ঐ দিন কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ মাঠে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় লাল সবুজের ছয়টি তারা খচিত একটি পতাকা স্বাধীন বাংলার পতাকা হিসাবে উড়িয়ে দেয়া হয় ; পাঠ করা হয় স্বাধীন বাংলার ইশতেহার। ২৩শে মার্চ কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠে পূনরায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়া ছিল ৮ নং সেক্টরের অধীনে। যশোর, কুষ্টিয়া জেলা, দৌলতপুর, সাতক্ষীরা সড়ক পর্যন্ত খুলনা জেলা এবং ফরিদপুরের কিছু অংশ নিয়ে এই সেক্টর গঠিত। সাতটি সাব-সেক্টর নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল কল্যাণীতে। এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (পরবর্তীকালে লে. কর্নেল ) এবং পরে আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মেজর এম.এ মঞ্জুর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।আবু ওসমান চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর পদে কুষ্টিয়ায় কর্মরত ছিলেন। পাকি সরকারের অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে ২৬ মার্চ তিনি কুষ্টিয়ার চুয়াডাঙার ঘাঁটিতে পৌঁছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে সসৈন্য যোগ দেন এবং সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন। সেখানে পৌঁছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, পদ্মা-মেঘনার পশ্চিমাঞ্চলকে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন নামকরণ করে নিজেকে অধিনায়ক ঘোষণা করেন। ৪র্থ ইপিআর সদর দফতরে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে লাল সূর্যের মাঝে মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সালাম প্রদান করেন।
তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দেয়া নকশার উপর ভিত্তি মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী কুষ্টিয়ার মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত জয় বাংলা বাহিনী নিয়ে পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর সাথে প্রথম সন্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন ৩০ মার্চ।
১ এপ্রিল বাংলাদেশের মধ্যে কুষ্টিয়া প্রথম শক্রমুক্ত হয়।বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র কুষ্টিয়া জেলা ১৬ দিন শত্রুমুক্ত থাকে। আর এই ১৬াট দিনই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের রক্ত¯œাত পথে এক সনজীবনির মতো। স্বাধীনতার মহানায়ক বাঙালীর সকল ত্যাগের প্রধান অনুপ্রেরণা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাকিস্থানের অন্ধকার কারাগারে বন্দী, যখন পাকিস্থান বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে বিশে^র কাছে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে দেখাতে মরিয়া তখন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অন্য মহান নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী দেশ ভারত থেকে একটি স্বাধীনতার ইশতেহার তৈরি করেন। সেই ইশতেহার ঘোষণার জন্য বাংলাদেশের ভুমিতে খুব প্রয়োজন ছিল একটি মুক্তাঞ্চল। প্রতিরোধ যুদ্ধে ‘স্বাধীন’ হওয়া সেদিনের কুষ্টিয়াঞ্চল ছিল সেই ভুমি ; কুষ্টিয়ার অন্যতম মহকুমা মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা (বর্তমান মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলা)। সেখানে দাঁড়িয়েই সেদিন ঘোষিত হয় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার। যে সরকারের অধীনে পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ।
ঐ সরকারের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) নির্বাচিত করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম পরে তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেন। মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা হলেন- এম মনসুর আলী (অর্থ বাণিজ্য ও শিল্প) এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ, পুনর্বাসন ও কৃষি)। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি খন্দকার মোশতাক আহমদও (পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ) মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। মুজিবনগর সরকারকে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ভাগ করা হয়। এ ছাড়া কয়েকটি বিভাগ মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীনে থাকে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুদ্ধরত অঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতিটিতে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। তবে ১০নং বা নৌ সেক্টরে কোনো সেক্টর কমান্ডার ছিল না, কমান্ডোরা যখন যে এলাকায় অভিযান করতেন সে সেক্টরের কমান্ডারের অধীনে থাকতো। মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথতলায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান এম এন এ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এম.এন.এ। নবগঠিত সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে এখানে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। আর সেই অনুষ্ঠানে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করেছিলেন ১৭ বছরের এক কিশোর মো. বাকের আলী। এদিকে ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীরা শপথ নিলেও ১৮ই এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভায় মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন করা হয়। মুজিবনগর সরকারের সফল নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জনের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। শুধু তাই নয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের এই প্রথম সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এর আগে ভারত এবং ভুটান এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।
সেদিন যে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছিল তা খুবই কঠিন কাজ ছিল। বিশ^ সম্প্রদায়ই সেদিন এরকই আখ্যা দিয়েছিল। এ সরকার গঠনের পেক্ষাপট তাই সেদিন বিদেশী সাংবাদিক, কাটনীতিকদের আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। সেদিন যদি এটি গঠন করা না হতো তাহলে দেশুজড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া জনযুদ্ধ ও আন্দোলনগুলি কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যেত না এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এতো বেগবান করা যেতো না।
সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর : ড. আমানুর আমান,এম.ফিল (আইইউকে), পিএইচডি ( এনবিইউ- দার্জিলিং)
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: শাহনাজ আমান।
কার্যালয়:- থানা ট্রাফিক মোড়, কুষ্টিয়া।মোবাইল- ০১৭১৩-৯১৪৫৭০, ইমেইল: info.dailykushtia@gmail.com
ই-পেপার কপি