December 23, 2024, 7:59 pm
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
ইউক্রেনে যুদ্ধ নিয়ে বাকি বিশ্বের সঙ্গে পশ্চিমাদের দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এ ঘটনা আসছে দিনগুলোতে এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার ইঙ্গিত বলে মনে করে উরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (ইসিএফআর) জরিপ।
ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (ইসিএফআর) নামের থিংকট্যাংক পরিচালিত সমীক্ষায় ফ্রান্স, জার্মানি ও পোল্যান্ডসহ ৯টি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সদস্য রাষ্ট্র এবং ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি চীন, রাশিয়া, ভারত ও তুরস্কের জনগণের মত জানতে চাওয়া হয়।
সমীক্ষা প্রতিবেদনের লেখকরা বলছেন, গণতন্ত্র ও ক্ষমতার বৈশ্বিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভৌগোলিক পার্থক্য রয়েছে। রাশিয়ার আগ্রাসন হতে পারে নতুন ‘পশ্চিমা পরবর্তী’ এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা উত্থানের ঐতিহাসিক মোড়।’
থিংক ট্যাংকটির পরিচালক এবং প্রতিবেদনের সহ-লেখক মার্ক লিওনার্ড বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রচলিত মতের বিরুদ্ধ মত হলো– একই সঙ্গে পশ্চিমারা আগের চেয়ে অনেক বেশি একত্রিত এবং তারা বিশ্বে কম প্রভাবশালী।’
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইউরোপিয়ান স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক টিমোথি গার্টন অ্যাশও এ গবেষণায় কাজ করেছেন। ফলাফলগুলোকে তিনি ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘জরিপে দেখা গেছে, যুদ্ধটি আটলান্টিক ছাড়িয়ে পশ্চিমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে এবং তারা দিশা খুঁজে পেয়েছে।’
কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হলো, পশ্চিমারা যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে চীন, ভারত ও তুরস্কের মতো শক্তিকে পাশে আনতে পারেনি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানে স্পষ্ট শিক্ষণীয় বিষয় হলো: পশ্চিমাদের এমন একটা আখ্যান প্রয়োজন, যা সত্যিকার অর্থে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের মতো রাষ্ট্রগুলোকে কাছে টানতে পারবে।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, গত বছর রাশিয়ার প্রতি পশ্চিমাদের মনোভাব কঠোর হয়েছে। ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ (৭৭%), যুক্তরাষ্ট্রে (৭১%) এবং ৯টি ইইউ রাষ্ট্রে (৬৫%) মানুষ রাশিয়াকে ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে বিবেচনা করে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১৪%, ৯টি ইইউ রাষ্ট্রে ১৫% এবং ব্রিটেনে ৮% মানুষ রাশিয়াকে ‘বন্ধু’ বিবেচনা করেন। মস্কোকে তারা ‘স্বার্থপর’ ভাবে না, মনে করে প্রয়োজনীয় অংশীদার। পশ্চিমা উত্তরদাতারা রাশিয়াকে বর্ণনা করার সময় সমান নেতিবাচক ছিলেন।
‘ইউক্রেন যুদ্ধকে আপনারা কীভাবে দেখেন’- এমন সম্ভাব্য ১০ উত্তরের মধ্য থেকে প্রতিজনকে দুটি বেছে নিতে বলা হয়। দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে ৪৫ শতাংশ বেছে নিয়েছেন রাশিয়া ‘আক্রমণাত্মক’ এবং ‘অবিশ্বাসযোগ্য’ নির্বাচন করেছেন ৪১ শতাংশ উত্তরদাতা। ৯টি ইইউ দেশে ৪৮ শতাংশ ‘আক্রমণাত্মক’, ৩০ শতাংশ ‘অবিশ্বাসযোগ্য’ বলেছে। ব্রিটেনে এ ফলাফল যথাক্রমে ৫৭ এবং ৪৯ শতাংশ।
৯টি ইইউ দেশে গড়ে ৫৫% মানুষ মস্কোর বিরুদ্ধে অব্যাহত নিষেধাজ্ঞাগুলোকে সমর্থন করেছেন, যেখানে গোটা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ছুটছে।
ইসিএফআর বলছে, গত গ্রীষ্মে চালানো একই ধরনের জরিপের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর জনগণ এখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধকে গণতন্ত্র ও নিজেদের নিরাপত্তার লড়াই হিসেবে বিবেচনা করছেন। শুধু ইউক্রেনে নয়, ইউরোপের যুদ্ধ হিসেবে ভাবছেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬ শতাংশ উত্তরদাতারা বলেছেন, মার্কিন গণতন্ত্রকে রক্ষার তাগিদ থেকে ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন দেওয়া হচ্ছে। বাকিরা সমর্থন দিচ্ছে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। তবে যুক্তরাজ্যে (৪৪ শতাংশ) ও ইইউ’র ৯টি দেশে (৪৫ শতাংশ) বলছেন, ইউক্রেনকে সমর্থন করার অর্থ হচ্ছে নিজেদের নিরাপত্তার প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা।
ইউরোপের (ব্রিটেনে ৪৪%, ইইউর ৯ দেশে ৩৮%) মানুষ মনে করেন, যে করেই হোক ইউক্রেনকে রাশিয়ার দখলকৃত সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করা উচিত। এমনকি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলেও। আর ২২ থেকে ৩০ শতাংশ চান যুদ্ধ যত তাড়াতাড়ি বন্ধ হোক। প্রয়োজনে ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড রাশিয়াকে ছেড়ে দেওয়া হোক।
জরিপে প্রাচ্যের দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া খুব আলাদা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, চীন (৭৬%), ভারত (৭৭%) ও তুরস্কের (৭৩%) মানুষ মনে করেন, রাশিয়া এখনও যুদ্ধে আগের মতোই ‘শক্তিশালী’। মস্কোকে তাদের দেশের কৌশলগত ‘মিত্র’ এবং ‘প্রয়োজনীয় অংশীদার’ হিসেবে মনে করেন যথাক্রমে (৭৯%,৭৯%,৬৯%)।
একইভাবে, চীনে ৪১%, তুরস্কে ৪৮% ও ভারতে ৫৪% মানুষ চান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুদ্ধ শেষ হোক। প্রয়োজনে ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকুক। তিনটি দেশে যথাক্রমে মাত্র ২৩%, ২৭% এবং ৩০% বলেছেন, ইউক্রেনের উচিত দখলকৃত সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করা, প্রয়োজনে দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের মাধ্যমে।
পশ্চিমাদের উদ্দেশ্য নিয়েও দেশ তিনটির মানুষের মধ্যে সংশয় রয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া চীন ও তুরস্কের এক-চতুর্থাংশেরও কম এবং ভারতের মাত্র ১৫%, মানুষ মনে করেন, পশ্চিমারা ইউক্রেনকে সমর্থন করছে নিজের নিরাপত্তা বা গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখার জন্য।
রাশিয়ার উত্তরদাতাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের (৬৪ শতাংশ) যুক্তরাষ্ট্র ‘প্রতিপক্ষ’। ইইউকে ৫১ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যকে (৪৬ শতাংশ) ‘প্রতিপক্ষ’ মনে করেন। চীনের উত্তরদাতাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ৪৩ শতাংশ, যুক্তরাজ্যকে ৪০ শতাংশ এবং ইইউকে ৩৪ শতাংশ প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন।
পশ্চিমের বাইরের অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, আগামী দশকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন উদারপন্থিদের বৈশ্বিক প্রভাব হ্রাস পাবে। একাধিকের মধ্যে পশ্চিমারা একটি বৈশ্বিক শক্তি থাকবে। রাশিয়ার মাত্র ৭ শতাংশ এবং চীনের ৬ শতাংশের পূর্বাভাস হলো, এখন থেকে দশ বছর পর তাদের দেশ প্রভাব বিস্তার করবে।
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে অনেকেই (ব্রিটেনে ২৯%, ইইউ’র ৯ দেশে ২৮% এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২৬%) যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নেতৃত্বে বিশ্বকে নতুন দুটি মেরুতে দেখার পূর্বাভাস দিয়েছেন। তবে উদীয়মান শক্তির দেশগুলোতে ভবিষ্যৎকে আরও বহুমাত্রিক মেরূকৃত বিশ্ব হিসেবে দেখার ইঙ্গিত রয়েছে।
এদিওক, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে চীনের উপ রাষ্ট্রদূত দাই বিং বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর নিষ্ঠুর ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। অস্ত্র পাঠানোর মধ্যে দিয়ে শান্তি আসতে পারে না, তার যথেষ্ট প্রমাণ এই যুদ্ধ।
বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) তিনি আরও বলেন, আগুনে জ্বালানি যোগ করলে কেবল উত্তেজনা বাড়বে। সংকট দীর্ঘায়িত হবে এবং মানুষকে আরও বেশি মূল্য দিতে হবে।
সাধারণ পরিষদে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে নিয়ে, দীর্ঘস্থায়ী শান্তি স্থাপন, রাশিয়ার সেনা প্রত্যাহার এবং যুদ্ধ বদ্ধের দাবিতে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ১৪১টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। ৩২টি দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। রাশিয়াসহ আরও ছয়টি দেশ এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। প্রস্তাব পাশের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে এই মন্তব্য এলো।
বৃহস্পতিবার ভোটদানে বিরতি থাকে রাশিয়ার মিত্র চীন। জাতিসংঘে চীনের উপ রাষ্ট্রদূত দাই বিং সতর্ক করে আরও বলেন, ‘ইউক্রেন সংকটের এক বছরে এসেও লড়াই এখনও ক্রমবর্ধমান। অগণিত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এ নিয়ে আমরা গভীর উদ্বিগ্ন। ইউক্রেন ইস্যুতে চীনের অবস্থান ধারাবাহিক ও স্পষ্ট। সব দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করতে হবে। জাতিসংঘ সনদের উদ্দেশ্য ও নীতিগুলো মানতে হবে। সব দেশের বৈধ নিরাপত্তা উদ্বেগকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত’।
আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রের পর পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোর মহাসচিব জেন্স স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের কথা হয়ত পরিকল্পনা করছে চীন। ন্যাটো মহাসচিব বলেছেন, যদিও এখন পর্যন্ত চীন থেকে রাশিয়ায় কোনও প্রকৃত অস্ত্র সরবরাহ দেখেনি ন্যাটো। কিন্তু ইঙ্গিত রয়েছে, হয়ত চীন এমন কিছু পরিকল্পনা করছে।
Leave a Reply