December 28, 2024, 1:14 am
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদী পদ্মায় সেতু নির্মাণের কাজ সত্যিই জটিল ছিল। আরো জটিল হয়ে উঠেছিল যখন বিশ্বব্যাংক ও এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সেদিন নিছক সন্দেহের বশে অভিযোগ তুলেছিলেন। প্রকল্প থেকে সড়ে দাঁড়িয়েছিল। এরপরই শুরু হয়েছিল নানা সমালোচনা। দেশে-বিদেশে শুরু হয় সরকারের সমালোচনা। সরকারের মন্ত্রী, আমলারা সমালোচনার টার্গেটে পরিণত হন। এমন বাদ যান না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যবর্গ—তার ছেলে মেয়েসহ অনেকেই।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হবে না বলেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধের পর ২০১১ সালের ১৭ অক্টোবর খালেদা জিয়া বলেছিলেন, স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন বাতিল কর ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক আলোচনায় বিএনপি নেত্রী বলেন, পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না। অনেক রিস্ক আছে।
২০১২ সালের ১ জুলাই সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ ড. আকবর আলি খান বলেছিলেন, বিশ্ব ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের পক্ষে পরবর্তীতে ঋণ সহায়তা পাওয়া খুব দুষ্কর হয়ে পড়বে। যখনই কোনো দাতা সংস্থা কোনো নতুন প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহী হবে, তারা দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশকে ভিন্ন চোখে দেখবে। সরকার যদি বিকল্প অর্থায়নে পদ্মা সেতু কাজ শুরু করে, তাহলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে, কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছিলেন, দুর্নীতি যে আমাদের পেছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এবং দেশের উন্নয়নের ধারাকে নষ্ট করছে, এই ঘটনা তারই আরেকটি উদাহরণ।
বিশ্ব ব্যাংকের অভিযোগকে ‘দুঃখজনক ঘটনা’ আখ্যা দিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আলী আহসান মনসুর বলেছিলেন, সুশাসনের অভাবে দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প আজ অনিশ্চয়তার মুখে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছিলেন, বিকল্প উৎস থেকে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করতে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা দৃষ্টি সরানোর (দুর্নীতির অভিযোগের ওপর থেকে) উপায় বলে মনে হতে পারে। যদি এই সিদ্ধান্ত সফলও হয় তাতেও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে না।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২০১২ সালের ১০ জুলাই বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংক সুনির্দিষ্টভাবে তিন জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত এম কে আনোয়ার বলেছিলেন, নিজস্ব অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার মতো ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।
২০১২ সালের ২৩ জুলাই বিএনপি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে জানায়, অভিযোগ ওঠার ১০ মাস পর যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ এটাই প্রমাণ করে যে এই প্রকল্পে আসলেই দুর্নীতি হয়েছে।
২০১২ সালের ২৪ জুলাই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, আবুল হোসেনের পদত্যাগ এটাই প্রমাণ করে যে দুর্নীতির সকল অভিযোগ সত্য। তিনি যদি আরও আগেই পদত্যাগ করতেন তাহলে (বিশ্বব্যাংক) ঋণচুক্তি বাতিল করত না।
আবুল হোসেনের পদত্যাগ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখন অনেক দেরি হয়ে গেল। কয়েক মাস আগে বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতির অভিযোগ আনল তখনই (পদত্যাগ) হওয়া উচিত ছিল।
একই প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ ড. আকবর আলি খান বলেছিলেন, অনেক দেরিতে আসল এই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত, আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল।
২০১২ সালের ২৮ জুলাই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, আবুল হোসেন কোনো দেশপ্রেমিক নন, তিনি একজন নির্লজ্জ ব্যক্তি। তাই তিনি বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ আসার ১০ মাস পরে পদ ছেড়েছেন। একজন দুর্নীতিবাজের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী এতদিন সাফাই গেয়েছেন।
প্রয়াত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এএসএম হান্নান শাহ বলেছিলেন, শেখ হাসিনা একজন দুর্নীতিগ্রস্ত প্রধানমন্ত্রী। তারও উচিত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।
প্রয়াত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেছিলেন, আবুল হোসেন যদি দেশপ্রেমিক হয় তাহলে দেশপ্রেমিক নয় কে? তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন এটাই প্রমাণ করে যে জনগণের অর্থ আত্মসাতকারীদের রাজনৈতিক দলে থাকার অধিকার রয়েছে।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছিলেন, কেন প্রধানমন্ত্রীর কাউকে দেশপ্রেমিক বলে সার্টিফিকেট দিতে হবে? আর কেনইবা সেটা লন্ডন গিয়ে করতে হবে? প্রধানমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী যোগাযোগ মন্ত্রীর যদি আত্মসম্মানবোধ থাকত তাহলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পদত্যাগ করতেন।
২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিএনপি জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে।
২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেছিলেন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে দুদক নিজেদের দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। দুদক যদি নিজেদের দায়িত্ব পালন করত তাহলে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিত না। উন্নয়ন সহযোগীদের পাশাপাশি দেশের জনগণও দুদকের কাছ থেকে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ভূমিকা আশা করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দীন বলেছিলেন, নিজ অর্থায়নে সরকার পদ্মা সেতু করার যে পরিকল্পনা করেছে তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে সরকার ইচ্ছা করলে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারবে; কিন্তু শেষ করতে পারবে না।
আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেছিলেন, পদ্মা সেতু দেশি অর্থায়নে হবে না, সম্ভব নয়।
২০১২ সালের ১ জুলাই পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করতে পারলেও শেষ করার গ্যারান্টি থাকবে না… এই মুহূর্তে সরকার নিজস্ব অর্থে করতে গেলে ডলারের দাম আরও বেড়ে যাবে এবং টাকার মান ব্যাপকভাবে কমে যাবে। বাড়বে অযাচিত মুদ্রাস্ফীতি।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন, যা যোগান দিতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়বে। এর দায় সরকার এড়াতে পারবে না… তবে এজন্য তাদেরও ভয়ঙ্কর নতুন সমস্যায় পড়তে হবে।
সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেছিলেন, এই মুহূর্তে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু শুরু করা হলে দেশের অন্যসব অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যে কাজগুলো করা যেত সেগুলো আর হবে না।
Leave a Reply