December 22, 2024, 8:53 am
ড. আমানুর আমান/
পদ্ম সেতুকে ঘিরে সকল জল্পনা-কল্পনা শেষ। নানা চড়াই-উৎরায় পেরিয়ে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সেতুটি এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। এই দৈর্ঘ্য এখন এক দীর্ঘ প্রত্যাশা ও অমিত সম্ভাবনার নাম ; ঐ প্রস্থ নতুন এক দিগন্তের নাম ; আত্মবিশ^াস ও দৃঢ় এক মনোবলের নাম। আর এর মধ্য দিয়েই স্কেপ্টিসিস্টদের (যারা যে কোন কিছুকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন) মুখে চুন-কালী মাখিয়ে খুব শক্ত একটি ‘উইল ফোর্স’র মহা বিজয় হয়েছে। এই ‘উইল ফোর্স’র প্রতীক হলেন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ; একজন জননেত্রী ; গনতন্ত্রের মানসকন্য ; ৫৫ হাজার বর্গমাইলের ১৮ কোটি মানুষের সবচে’ নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
যদিও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের এ সরকার ইতোমধ্যে যুগান্তকারী অসংখ্য উন্নয়ন অগ্রযাত্রা তৈরি করেছে যেগুলিও ঈর্ষনিয় রুপকল্পের মতো যেমন রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু সেতু, পায়রা সমুদ্র বন্দর, বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরী স্থাপন, সমুদ্রবক্ষে ব্ল-ইকোনমির নতুন দিগন্ত উন্মোচন, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট সফল উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ জয়, বাংলাদেশের সাবমেরিন যুগে প্রবেশ, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন উড়াল সেতু, মহাসড়কগুলো ফোর লেনে উন্নীত করণ, এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয় দুই হাজার ২২৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত, রিজার্ভ ৩.৫ বিলিয়ন থেকে রিজার্ভ প্রায় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে কাছে উন্নীত, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, বিদ্যুত উৎপাদন ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াটে উন্নীত, যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশে উন্নীত করা, বছরের প্রথম দিনে সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই পৌঁছে দেওয়া, মাদরাসা শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা ও স্বীকৃতি দান, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, প্রত্যেকটি জেলায় একটি করে সরকারি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, নারী নীতি প্রণয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, ফোর-জি মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার চালুসহ অসংখ্য ক্ষেত্রে কালোত্তীর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
এসবের বাইরে সদ্য সমাপ্ত পদ্মা সেতু নতুন এক উচ্ছাস তৈরি করেছে। কারন এই সেতু বাংলাদেশকে নতুন ভাবে উপস্থাপন করেছে বিশে^র কাছে ; বাংলাদেশকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবনার জায়গা তৈরি করেছে। বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীকে নতুন চাঁদ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মুলে ছিল সঞ্জীবনী নিজস্ব অর্থায়নের সাহস ও সক্ষমতা। নিজস্ব অর্থে এরকম একটি সেতু নির্মাণ করতে সক্ষম হবার ফলে সারা বিশে^র কাছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও সম্ভাবনার একটি শক্ত ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কারন বাংলাদেশের জন্য পদ্মা সেতু নির্মাণ খুবই একটি চ্যালেঞ্জিং ছিল। চ্যালেঞ্জ ছিল শুরুর পর শতভাগ সমাপ্ত করার সফলতারও। বলা বাহুল্য, পুরো ইভেন্টে এখন পর্যন্ত কোন ব্যর্থতা নেই ; পুরোটাই সফলতার। আর এই সফলতায়ই একটি উচ্চতম কৃতিত্ব তৈরি করে দিয়েছে এবং এই কৃতিত্বই উচ্ছাসের কারন এবং এরও কারন রয়েছে সেটি হলো এটি শুধু একটি বড় সেতু নির্মাণ শুরু ও শেষ করা নয় ; এটি অর্থনৈতিক অগ্রগতির, ক্রমাগত জিডিপি প্রবৃদ্ধির এবং বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতির দ্বার উন্মুক্ত করেছে।
এসবই সম্ভব হয়েছে একজন শেখ হাসিনা এবং তাঁর দৃঢ়তা ও সাহসী সিদ্ধান্তের কারনে। তাঁর গগনচুম্বী মনোবল তাঁকে এবং তাঁর সমগ্র দেশবাসীকে একটি আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে। কারন পদ্মা সেতুকে শুধু একটি সেতু হিসেবে দেখা হচ্ছে না ; দেখা হচ্ছে সম্পদ হিসেবে ; সম্পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া হিসেবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসাব দেখুন। তারা বলছে পদ্মা সেতুর ফলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ এবং আঞ্চলিক জিডিপি ২ দশমিক ৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। অন্য এক হিসাবে সারাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যাবে ২ দশমিক ২ শতাংশে। যা কিনা ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে; দারিদ্র্যের হার হ্রাস করবে প্রায় ১ শতাংশ করে ; দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও অর্থায়ন ত্বরান্বিত করবে।
অমিত তেজে মাথা তুলবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল/
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক যে আঞ্চলিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা বলছে সেটা নিয়ে চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ চলছে। অন্যদিকে এই সেতুকে ঘিরে যেসব সম্ভাবনা ও প্রত্যাশার জন্ম হয়েছে তা নিয়েও চলছে নানা হিসেব নিকেশ। বলা হচ্ছে সেতুটি রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। সেতুটি একটি বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্ম দিতে যাচ্ছে ; যা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা হতে সহায়তা করতে যাওয়ার পাশাপাশি একটি বিশেষ অঞ্চলের মধ্যে একটি কানেকটিভ ভূ-রাজীতির পরিমন্ডল তৈরি করতে যাচ্ছে। এ অঞ্চলটি হলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। তিনটি বিভাগের একুশটি জেলার সন্বিবেশ এই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। এই জেলাগুলো হচ্ছে- খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী।
বলা হচ্ছে সেতুটি এ অঞ্চলের রাজনীতি, অর্থনীতি ও ভৌগলিক কাঠামোতেও অনেক রদবদল ঘটাতে যাচ্ছে। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণের মধ্যে উন্নয়ন বন্টন বৈষম্যের যে দীর্ঘ সংস্কৃতি চলে আসছে তার উপর বড় রকমের আঘাত করতে যাচ্ছে সেতুটি এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নিস্ক্রিয় করে দিতে যাচ্ছে এসব বৈষম্যের সকল শাখা-প্রশাখা। কারন সেতু সক্রিয় থাকলে যোগাযোগ সক্রিয় থাকবে ; যোগাযোগ সক্রিয় থাকলে অর্থনীতি সক্রিয়ভাবেই নিজস্ব প্রবাহ তৈরি করতে সক্ষম হবে। আমরা যদি মোটাদাগে এব জেলাগুলোর বর্তমান অর্থনৈতিক ঘটনা-প্রবাহের দিকে নজর দিই উপরোক্ত কথার সত্যতা পেয়ে যাব। দীর্ঘ সময় ধরেই এই জেলাগুলো সরকারী বা ব্যাক্তি উদ্যোগে অর্থনৈতিক প্রবাহে সক্রিয় ছিল। সারাদেশের অনেক জেলার মধ্যে কোন কোন জেলা অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালীও বটে। যেমন বাগেরহাটের মোংলা বন্দর ; যেমন কুষ্টিয়া যা দীর্ঘ সময় ধরে দারিদ্র সীমার বাইরে থাকার সক্ষমতার একটি জেলা। এই সেতু এগুলোকে আরো বেগবান করতে যাচেছ। ইতোমধ্যে আমরা দেখছি সেতু নির্মাণ শুরু হবার পরপরই এই অঞ্চলের চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতের স্বপ্নে গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৫ কোটি মানুষ এখন উজ্জীবিত।
সম্প্রতি বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হবার পর খুলনা বিভাগে বেসরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। উল্লেখযোগ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে, জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল, এলপি গ্যাস, অটো রাইসমিল, মাছের হ্যাচারি ও হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, ফুড অ্যান্ড এলাইড প্রোডাক্টস, ক্যাটল, পোল্ট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিড, প্রকৌশল শিল্প, রসায়ন শিল্প, ফার্মাসিউটিক্যাল, ফার্টিলাইজার, কোল্ড স্টোরেজ, প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, উড অ্যান্ড পার্টিকেল বোর্ড প্রসেসিং, ডক ইয়ার্ড শিল্প, সার্ভিস (সেবা শিল্প), ডেইরি প্রোডাক্টস অ্যান্ড ডেইরি ফার্ম, অটোমেটিক ব্রিক ফিল্ড, প্লাস্টিক প্রোডাক্টস, নির্মাণশিল্প, পোল্ট্রি হ্যাচারি, পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং চামড়া ও ট্যানারি শিল্প ইত্যাদি।
ওদিকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোংলা বন্দরের গুরুত্ব বহুগুণ সম্প্রসারিত হতে শুরু করেছে। পদ্মা সেতু রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের ব্যবসা-বাণিজ্যিক অঞ্চলগুলোর সঙ্গে মোংলা বন্দরের যোগাযোগ বাড়িয়ে দেবে। চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরত্ব কমে যাবে। এ কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যে মোংলা বন্দরে আমদানি ও রপ্তানিকৃত মালামাল ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোতে পৌঁছানো সম্ভব হবে। যার ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মোংলা বন্দর ব্যবহারে আরো বেশি আগ্রহী হবে।
আমরা সুনীল অর্থনীতির কথা বলছি। দেশের দক্ষিণাঞ্চল এই সুনীল অর্থনীতির জনপদ। এখানে বিস্তীর্ণ এলাকা মৎস্য চাষ ও আহরণের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। চিংড়ি ও সামুদ্রিক মাছের সরবরাহ আসে মূলত দক্ষিণাঞ্চল থেকে। সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে আছে অসংখ্য মাছের ঘের। সেখানে গড়ে উঠেছে অনেক প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। তাতে কাজ করছে অসংখ্য মানুষ।পদ্মা সেতুর ফলে নিবিড় মৎস্য চাষ উৎসাহিত হবে। রেণুপোনাসহ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিদেশে মৎস্য প্রেরণ সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত হবে। তাতে মাছের অপচয় হ্রাস পাবে। আয় বাড়বে ক্ষুদ্র মৎস্য চাষীদের। তাছাড়া সুনীল অর্থনীতি হবে গতিশীল। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে বলা হয় শস্যভান্ডার ; অনেকে আবেগ দিয়ে বলেন প্রাচ্যের শস্যভান্ডার। কিন্তু এই ভান্ডারকে পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। কারন দেশের অন্য অঞ্চলের চেয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শস্য নিবিড়তা অপেক্ষাকৃত কম। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের অন্য অঞ্চলে কৃষি বিপ্লব অনেকটাই সফল হয়েছে। এটার প্রধান কারন হলো যোগাযোগের অসুবিধা। যা জন্ম দিয়েছে উপকরণ পরিবহনে দীর্ঘসূত্রিতা। যার ফলাফল হলো উৎপাদিত পণ্য বিপণনে দুর্ভোগ। যার ফল হলো অর্থ আয় প্রবাহে দুর্বলতা। পদ্মা সেত এ অঞ্চল থেকে এ সীমাবদ্ধতাটা দ্রæত তুলে নেবে। নতুন প্রযুক্তি ধারণ ত্বরান্বিত করবে। বিপণন সহজ হবার কারনে দ্রæত বেড়ে যাবে শস্যের উৎপাদন। গড়ে উঠবে কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা। সেখানে মানুষের বাড়বে কর্মসংস্থান, বাড়বে আয়।
পদ্মা সেতুর ওপাড়ে শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুরে রয়েছে ফসল চাষের বিস্তীর্ণ জমি। শাকসবজি ও মসলাজাতীয় ফসল উৎপাদনের জন্য এসব জমি খুব উপযোগী। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ উন্নত হওয়ায় এখানে ফসলের পচনশীলতা কমবে। বিভিন্ন শাকসবজি এবং মসলা ফসলের, বিশেষ করে পেঁয়াজ ও রসুনের উৎপাদন বাড়বে। এই তিন জেলার চরাঞ্চলের বাদাম ও পাটচাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়বে। বাড়বে উৎপাদন। গড়ে উঠবে পাটভিত্তিক শিল্প। বরিশাল ও পটুয়াখালী জুড়ে প্রচুর তরমুজ উৎপাদিত হয়। দেশের বিশেষ কিছু অঞ্চল ব্যাতিত রাজধানীর দুই কোটি মানুষের বাজারে তা আসা খুবই কষ্টকর। এর কারন যোগাযোগ অপ্রতুলতা। অন্যদিকে রক্ষণাবেক্ষণের অসুবিধাসহ বিপণন সমস্যার কারণে কৃষক তরমুজ চাষে তেমন লাভবান হন না। পদ্মা সেতু এ সমস্যা দূর করবে। দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ চরে নারিকেল ও সুপারির চাষ হয়। সমতলে হয় পান ও তেজপাতার চাষ। পটুয়াখালীতে মুগ ডালের চাষ হয় বাণিজ্যিকভাবে। সেতুর ফলে এসব কৃষিপণ্য বাণিজ্য ধরতে পারবে। এত চাষ উৎসাহিত হবে ব্যাপকভাবে।
কুষ্টিয়ার খাজানগরে রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম। এটি দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় চাল শিল্প এলাকা। দেশের চালের চাহিদার ৩০ শতাংশ জোগান যায় খাজানগর থেকে। কুষ্টিয়া জেলা খাদ্য অফিস সূত্র দেখাচ্ছে, খাজানগরসহ আশপাশের এলাকায় বর্তমানে ৪২টি অটো (স্বয়ংক্রিয়) রাইস মিল ও হাসকিং (ম্যানুয়াল) মিল আছে চার শতাধিক। প্রতিদিন এ মোকামে ৪ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়। এখান থেকেই দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে প্রতিদিন গড়ে ২০০ ট্রাক চাল যায়। যার বাজারমূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা। এ ছাড়া খুদ, গুঁড়া, পালিসসহ অন্যান্য অংশ মিলিয়ে প্রতিদিন খাজানগর মোকামে ২০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। তাই এলাকায় বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শাখাও রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান খাজানগরে। প্রায়ই হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে যায় চালের দাম। এর প্রভাবক প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি হচ্ছে অল্প খরচের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব। চালের বড় বাজার রাজধানী। অথচ সেখানে চাল সরবরাহ খুবই কষ্টসাধ্য একটি কাজ। পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করে দেবে। অন্যদিকে কুষ্টিয়ার বেসরকারী ওয়্যার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বিশ^জুড়ে যার খ্যাতি বিআরবি গ্রæপ একাই জেলার জিডিপি প্রায় ২ ভাগ অবদান রেখেছে।
বলা হচ্ছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটের চিত্র বদলে যাবে। ভোগান্তির যে চিত্র দেখে আসা হচ্ছে দীর্ঘদিন সেটি এখন স্বস্তির অপর নাম হবে। পদ্মা সেতু চালু হলে চিরায়ত রুপ পাল্টে যাবে এই নৌরুটটির। পাশাপাশি কমবে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আর অপেক্ষা করতে হবে না দক্ষিণবঙ্গের মানুষের। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডবিøউটিসি) বলছে পদ্মা সেতু চালু হলে এই নৌরুটের যানবাহন চাপ কমে যাবে প্রায় ৪০ শতাংশ। তখন যানবাহনগুলোকে আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। এটি সম্ভব হলে খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙা, মেহেরপুর ও ঢাকা জেলার রাজবাড়ী আরো বাড়তি সুবিধা পাবে। অতি স্বল্প সময়ে এই জেলাগুলো ঢাকা ছুঁতে পারবে।
তথ্য বলছে, পদ্মা সেতুর কারণে এই ২১ জেলার কোন কোন অংশে জায়গা-জমির দাম অনেক বেড়ে গেছে। সেতুর এপাশে মুন্সিগঞ্জ এবং ওপাশে শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুরে বহু মানুষ এখন নতুন স্বপ্ন দেখছে। লেবুখালী সেতু উদ্বোধনের পর বরিশালের সঙ্গে পটুয়াখালী জেলার আর কোনো ফেরি চলাচলের প্রয়োজন হচ্ছে না।এখন ঢাকার সঙ্গেও যান চলাচল সহজ হয়েছে। তাতে ফেরি পারাপারের ও লঞ্চে চলাচলের দুর্ভোগ ঘোচানো সম্ভব হয়েছে। ওই অঞ্চলে দ্রুত বেড়েছে জমির দাম। তাছাড়াও পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংযুক্ত এলাকায় নদীশাসনের ফলে অনেক কৃষিজমি নদীভাঙন থেকে রেহাই পেয়েছে।
পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এই বাংলাদেশ যার সিংহভাগ জুড়েই রয়েছে নদী। এই নদীমাতৃক বৈশিষ্ট এ ভূ-খন্ডকে যেমন দিয়েছে উর্বব পাললিক ভু-ভাগ তেমনী নদী শাসনে আমাদের সক্ষমতার অভাবের কারনে এই নদীই হয়েছে অনেক বেদনার কারন। বড় দুটি নদী যমুনা ও পদ্মা রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চকে। এই সেতু নির্মানের ফলে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজধানীর সাথে দ্রæত যোগাযোগে সক্ষম হলো। এটি মানুষের সক্ষমতার ক্ষেত্রকে অনেক সম্প্রসারিত করবে। এই অঞ্চলে পাটকল, চালকল পুরো মাত্রায় বিকশিত হবে। তৈরি হবে ইপিজেড এলাকা। মোংলা, পায়রা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। সুন্দরবন ও সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায় পর্যটন শিল্প বিকশিত হবে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল।
ইতিহাস বলছে পূর্ব থেকে নিজ ভু-খন্ডেই সমৃদ্ধ ছিল বাংলা জনপদ ; ছিল একটি দেশজ সমৃদ্ধি যা এই অঞ্চলকে দিয়েছিল এক কোমল সামাজিক পরিবেশ। যেখানে সুখ-ঐশ^র্য ও শান্তিবিরাজমান ছিল একটি অব্যাহত ধারার মতো ; সুজলা-সফলা-শষ্য-শ্যামলার এক বাংলা। একই কারনে এই অঞ্চলের উপর লোলুপ দৃষ্টিও ছিল বিভিন্ন শাসক-শোষক ও স্বার্থন্বেষী গোষ্ঠীর। নানা কৌশল, যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে একসময় তারা অনেকেই সফলও হয়। বাংলার বুক জুড়ে নেমে আসে স¤্রাজ্যবাদী বেনিয়া শাসন। এই ধারাবাহিকতায় বৃটিশের ১৯০ বছর, পাকিস্তানের ২৫ বছর ছিল শুধু ধারাবাহিক শোষণ, শাসন আর লুটতরাজ। এই বাংলায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক যে বিপর্যয় সেটি ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্র ধরেই। পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে সকল শোষণ, বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামও ছিল অঞ্চলের মানুষের। যে সংগ্রাম গুলো কখনও সীমিত বিজয়, আবার পরাজয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। মুক্তির সর্বশেষ জোরালো গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল কেবল ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে। দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে “বাংলাদেশ” নামক স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মহানায়ক ছিলেন এ ভু-খন্ডেরই হাজার বছরের সেই শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ; আমাদের জাতির পিতা।
শেখ হাসিনা ; জাতির পিতারই সুযোগ্য উত্তরাধিকার ; তাঁর হাতেই এখন বাংলাদেশ। তাঁর নেতৃত্বেই একটি নিশ্চিত গন্তব্য খুঁজতেই আমাদের লড়াই সংগ্রাম চলছে। বাংলাদেশকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত পরিকল্পনা, তাঁর দীর্ঘলালিত সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের লক্ষ্য ধরেই শেখ হাসিনার সুযোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার মেধা-মনন, সততা, নিষ্ঠা, যোগ্যতা, প্রজ্ঞা, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, উদারমুক্ত গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা ; এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
ড. আমানুর আমান, বিএসএস (অর্নাস) এমএসএস (লোকপ্রশাসন), এমফিল (আইইউ, কে), পিএইচডি (এনবিইউ-দার্জিলিং, ইন্ডিয়া), লেখক ও গবেষক। প্রকাশিত গ্রন্থ-২০ (ইংরেজী ভাষায় ১৪, বাংলা ভাষায়-৬), সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক কুষ্টিয়া ও দি কুষ্টিয়া টাইমস
Leave a Reply