December 22, 2024, 12:44 pm
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
২০২০ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের ১৫টি রাষ্ট্রীয় চিনিকলের মধ্যে ৬টিতে আখমাড়াই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ কলগুলো হলো পাবনা, কুষ্টিয়া, রংপুর, পঞ্চগড়, শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল। দেশে চিনির পর্যাপ্ত চাহিদা সত্বেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক না নিয়ে নানা প্রশ্ন। অভিযোগ করা হচ্ছে চিনি কলগুলো নিয়ে সরকারের সদিচ্ছা ও পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। সরকার ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দিতেই চিনিকলগুলোকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। সাধারণ জনগণের কথা সরকারের ভাবনায় নেই। অথচ এই সরকার যথেষ্ট ব্যবসায়ীবান্ধব সরকার।
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন ও চিনিকলগুলো ৬ হাজার ৪৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের সুদের পরিমাণ ৩ হাজার ৮৫ কোটি টাকা হয়েছে। বর্তমানে সদর দপ্তরের ঋণসহ চিনিকলগুলোকে ৭ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা সুদসহ বকেয়া ঋণ পরিশোধ করতে হবে। চিনিকলগুলোকে সরকার ভর্তুকি দিলে ৩ হাজার ৮৫ কোটি টাকা সুদ হতো না এবং চিনিকলগুলোর এমন বেহাল দশা হতো না।
বিশ্লেষকরা বলছেন সরকার ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ এখন এক হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরাই এখন রাজনীতিবিদ। তারা জনগণের স্বার্থের কথা আর বিবেচনা করে না। যারা সরকার, তারাই যখন ব্যবসায়ী হয়ে যায় বা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে থাকে, তখন জনস্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থ বড় হয়ে যায়। দেখা যায় জনগণের করের টাকা জনগণের স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহৃত হয় না। জনগণের সম্পদ লুটপাট বান্ধব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিখাতে চলে যায়। সেটিই ঘটেছে এখানে যার প্রভাব পড়েছে চিনিকলগুলোতে। কী করলে ব্যবস্থাপনা টেকসই হয়, দুর্নীতি দমন করা যায় ও দক্ষতার সঙ্গে পরিকল্পনা করতে হয়, সে বিষয়ে দূরদর্শিতার অভাব সবসময়ই ছিল।
চিনিশিল্প নিয়ে গবেষণা করছেন এমন অনেকেই বলছেন দেশে প্রতি ১০০ কেজি আখ থেকে ৬-৭ কেজি চিনি হয় অথচ ব্রাজিল ও ভারতে হয় ১২-১৪ কেজি। চিনি কম আহরণের কারণ হলো উচ্চ ফলনশীল ও অধিক চিনিযুক্ত আখের আবাদ কম হওয়া। তবে, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট দাবি করে যে, তাদের সরবরাহকৃত বীজে চিনি আহরণের হার ১২-১৪ শতাংশ। কিন্তু সিস্টেম লস, চিনিকলের যন্ত্রপাতি পুরনো হওয়া এবং মিলে দেরিতে আখ পৌঁছানোর কারণে চিনির আহরণ কম হয়। আখ কাটার পর একদিনের মধ্যে মিলে পৌঁছাতে না পারলে আখের সুক্রোজের মাত্রা কমে যায়। ফলে চিনি কম আহরণ হয়। দুর্বল যাতায়াত ব্যবস্থা ও সমন্বয়হীনতার অভাবে এই সমস্যা হচ্ছে।
ব্রিটিশ আমল থেকেই চিনি শিল্প একটি ভালো অবস্থানে ছিল। ২০২০ সালে লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে সরকার ৬টি চিনিকল বন্ধ করে দেয়। সরকার বলছে, চিনি আহরণ কম। কিন্তু কেন কম, এটি নিয়ে তারা কাজ করছে না। চিনি কম আহরণের কারণগুলো আগেই বলা হয়েছে। কেরু অ্যান্ড কোং কোম্পানির ডিস্টিলারি আছে। তা দিয়ে অ্যালকোহল, স্যানিটাইজার উৎপাদন করে। প্রেসমাড থেক জৈব সার উৎপাদন করে। ব্যাগাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এ ছাড়াও, কয়েকটি মিল উপজাত ব্যবহার করে বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করে। ফলে তুলনামূলকভাবে চিনিতে লাভ না হলেও এগুলো দিয়ে তাদের ক্ষতিটা পুষিয়ে যায়। ফলে তারা লাভজনক অবস্থানে থাকে। যেখানে উপজাতগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না, সেখানে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
অন্যান্য কলগুলোতেও এসব উপজাত ব্যবহার করে পণ্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। কিছু চিনিকলের নিজস্ব খামার আছে। অব্যবহৃত জমি ফেলে না রেখে অন্যান্য ফসল উৎপাদন করতে পারে। চিনিকলগুলো আগে নিজেরাই চিনি আমদানি করতো। কিন্তু বেসরকারি ৫টি রিফাইনারকে চিনি আমদানির সুযোগ দিতে গিয়ে চিনিকলগুলো আর আমদানি করে না। এখন চিনি আমদানি করে পরিশোধন করেও মিলগুলো বাড়তি আয় করতে পারে।
শুধু চিনি উৎপাদন করে লাভ করা বিশ্বের সব দেশেই কঠিন। কাজেই চিনি শিল্পের যে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে তার কারণে অন্য যেকোনো পণ্যের উৎপাদন ও মুনাফার সঙ্গে এর তুলনা করলে হবে না। চিনির পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়ার ভিন্নতাকে আমলে নিয়ে এর বিকাশে নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
আখ চাষিদের ঋণ দেওয়া হতো। চাষিরা ন্যায্যমূল্য পেলে বেশি আখ উৎপাদন করে এবং সরবরাহ বাড়ে। ফলে চিনির উৎপাদনও বাড়ে। আখ চাষিদের প্রতি বছর প্রণোদনা দিতে হবে। তাদেরকে বীজ ও সার সরবরাহ করতে হবে এবং ঋণ দিতে হবে। তাদেরকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে সরকার তাদের আখ কিনবে। তারা সঠিক সময়ে আখের মূল্য না পেলে নিরুৎসাহিত হন। ২০১০ এর দশকের শুরুর দিকে বেশ কয়েক বছর চাষিদের সময় মতো আখের মূল্য পরিশোধ করা হয়নি। তখন তারা নিরুৎসাহিত হয়েছে। আখ যখন মণ হিসেবে কেনা হয়, তখন সব ধরনে আখ একই মূল্যে কেনা হয়। ভালো আখের জন্য ভালো দাম দিতে হবে, কিন্তু সেটি করা হয় না। এতে করে চাষিরাও ভালো আখ সরবরাহে নিরুৎসাহিত হয় এবং চিনির আহরণও কমে যায়।
অথচ দেশের মাটি ও জলবায়ু আখ চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে অব্যবস্থাপনা ও চাষিদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না করার কারণে আমাদের দেশে আখের উৎপাদন কমে গেছে।
চিনিকলগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা থেকে সুযোগ নিচ্ছে বেসরকারি রিফাইনাররা। এতে করে বাজারের নিয়ন্ত্রণ বেসরকারি পরিশোধনকারীদের হাতে চলে যাচ্ছে। বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকলে ব্যবসায়ীরা যেকোনো সময় চাইলেই জনগণকে জিম্মি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে, যেমনটি হয়েছে তেলের ক্ষেত্রে। সরকার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সরকারের হাতে যদি কোনো সহজ মেকানিজম থাকতো তাহলে কিন্তু আমরা জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পেতাম। কিন্তু আমাদের সরকার সহজ রাস্তা খোঁজে। তারা নিজেরা কোনো পরিশ্রম করতে চায় না। আমাদের কলগুলোতে উৎপাদিত চিনি রিফাইন করা চিনির চেয়ে অনেক ভালো ও স্বাস্থ্যকর।
এক গবেষণায় রিফাইন করা চিনিতে ক্ষতিকর কনসেন্ট্রেটেড চিনির উপাদান পাওয়া গেছে। চাইলেই সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যকর চিনি খেতে পারছেন না। আমাদের সব চিনিকল সচল রেখে এবং শক্তিশালী করে চিনি উৎপাদন বাড়ানো হলে ব্যবসায়ীরা ঠুনকো অজুহাতে চিনির দাম বাড়াতে পারতো না। সেইসঙ্গে আমরাও স্বাস্থ্যকর চিনি পেতাম। কিন্তু সরকার ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়েছে।
চিনিকলগুলোকে লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া অবশ্যই সম্ভব। এর জন্য শুধু সরকারের সদিচ্ছা দরকার। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। কিন্তু দেখা যায় যাদের চিনি শিল্প সম্পর্কে তেমন কোনো জ্ঞান নেই তাদেরকে এই শিল্পর দায়িত্ব দেওয়া হয়। যারা দীর্ঘ দিন ধরে চিনিকলের উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত, যেমন কৃষক, শ্রমিক, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী, যারা ব্যবস্থাপনার ত্রুটি বিচ্যুতি ও সমস্যার কারণগুলো জানেন এবং মাইক্রো লেভেলে গিয়ে ব্যবস্থাপনায় পরামর্শ দিতে পারেন, দুর্নীতির চক্রকে কিভাবে ভাঙা যায় তা নিয়ে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারেন, তাদেরকে নিয়ে কমিটি গঠন করে একটি নতুন পরিকল্পনা করে অগ্রাধিকার দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান ও থাইল্যান্ডের ৩টি কোম্পানি নিয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম (সুগার ইন্টারন্যাশনাল) রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো সংস্কারে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে লাভজনকভাবে পরিচালনার প্রস্তাব দিয়েছে। জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন ও থাইল্যান্ডের এক্সিম ব্যাংক ৭০ শতাংশ টাকা কনসোর্টিয়ামকে ঋণ হিসেবে দেবে—এমন শোনা যাচ্ছে। এটি বাস্তবায়িত হওয়ার পর চিনিকলগুলোতে লোকসান হলে তার দায় শোধ করতে হবে কনসোর্টিয়ামকে এবং চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনকে। তারা ব্যর্থ হলে গ্যারান্টার ঋণ পরিশোধে বাধ্য থাকবে। গ্যারান্টার কোন ব্যাংকগুলো হবে এবং চিনিকলগুলোর কি কি বন্ধক রাখা হবে তার নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। কাজেই ব্যর্থ হলে জমি বিক্রি করে দেনা পরিশোধ করতে হবে।
এই জমিগুলো কম দামে কিনবে ব্যবসায়ীরা। আর বিদেশিরা যদি লাভ করতে চায় তারা কিন্তু চিনির দাম বাড়িয়ে সেটা করবে। লাভজনকভাবে চালাতে গেলে বিদেশি কনসোর্টিয়াম এমন কোনো শর্ত দিতে পারে, যা বহুদিন ধরে কৃষক ও চিনিকলগুলোর মধ্যে তৈরি হওয়া আস্থার সম্পর্ককে নষ্ট করে দিতে পারে। কৃষক নিরুৎসাহিত হতে পারে, উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
বাইরে থেকে ঋণ না নিয়ে নিজেদেরই কিছু করতে হবে। এই খাতে ভর্তুকি দিয়ে চিনিকলগুলো ভালো অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে। এতে করে আমদানি নির্ভরতা কমবে। ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে জনগণের সম্পদ বেহাত হবে না। রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে। দেশের টাকা দেশেই থাকবে এবং সাধারণ মানুষ সাশ্রয়ী ও স্বাস্থ্যকর চিনি খেতে পারবে।
Leave a Reply