October 30, 2024, 8:02 pm
ড. আমানুর আমান/
আজ পঁচিশে বৈশাখ, ১৬০ বছর আগে ঠিক এই দিনেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। আজ তাঁর ১৬১তম জন্মদিন।
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের স্থান ছিল এক বহুবর্ণময় আলোক”ছটার মতো ; অনন্য, অসাধারন। যে সাহিত্যের প্রায় সব’কটি ধারাই এই আলোক”ছটায় উদ্ভাসিত, সমৃদ্ধ। যদিও বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই শেষ কথা নয় তথাপিও তিনিই একমাত্র লিখিয়ে যিনি একটি সমগ্র সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন এককভাবে সবথেকে বেশী। তিনিআ একমাত্র একমাত্র একটি নিজস্ব অধ্যায় তৈরি করেছেন। যে অধ্যায় বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে এক সুমহান উ”চতা ; যে উচ্চতা বাংলা সাহিত্যকেই তুলে নিয়েছে বিশ্বচরাচরে। তিনি হয়েছেন বিশ্বকবি।
এক ভার্সেটাইল জিনিয়াস রবীন্দ্রনাথ যার সমগ্র জীবনই ছিল সৃষ্টির আধার, একাধারে ছিলেন কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কারক। এর ফল ছিল কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, ভ্রমণকাহিনী, চিঠিপত্র এবং দেশে বিদেশে প্রদত্ত বক্তৃতামালা। এতসব ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করে তিনি একটি সাহিত্যের সমগ্র সত্তা নির্মাণ করেছেন যেখানে সাহিত্য বাস্তবতা ছিল মিলিত প্রাণের প্রেমের। এই মিলন সমগ্র সত্তার সাথে প্রতিটি সত্তার ; প্রাণীজগৎ, নিসর্গ, প্রকৃতিকে। শুধু তাই নয়, শিল্পের জগত, কল্পনার জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের বিস্তার ঘটানো।
শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ/
এ লেখায় বিস্তর আলোচনা সূত্রপাতের কোন সম্ভাবনা নেই। ইতিহাসের নিরপেক্ষ সন্দর্শন যা বলবে সেটিই এখানে প্রণিধানযোগ্য।
আমরা যে রবীন্দ্রনাথকে সবথেকে বেশী চিনি সেটি মূলত কবি হিসেবে ; কবিতা ও গানেই তাঁর প্রতিভা বিশ্বময় স্বীকৃত। কবি হিসেবেই ১৯১৩ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এখানেও তিনি অনন্য ; কারন তার তুল্য আজবধি নেই। অন্যদিকে তাঁর কাব্য ছিল বহুবর্ণময় ; কখনও রক্ষণশীল ধ্রæপদি শৈলীতে, কখনও হাস্যোজ্জ্বল লঘুতায়, কখনও বা দার্শনিক গাম্ভীরে, আবার কখনও বা আনন্দের উ”ছাসে মুখরিত যার উৎস ছিল পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে রচিত বৈষ্ণব কবিদের পদাবলি সাহিত্য।
রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা ও গভীরতা এবং এর সৃষ্টিশীলতা এক সৌকর্যের সর্বো”চ চূড়ায় উপনীত হয় গ্রামীণ বাংলার লোকসঙ্গীতের লোকজ ধারার বিচিত্র প্রভাবে। এই সময় লালন শাহ সহ বাংলার বিশিষ্ট বাউল সংগীতস্রষ্টাদের সান্নিধ্যে আসেন কবি। বাউল সংগীতকে পুনরাবিষ্কার করে জনপ্রিয় করে তুলতে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা নেন। এই সব বাউল গান উনিশ শতকের কর্তাভজাদের গানের মতো অন্তর্নিহিত দৈবসত্ত্বার অনুসন্ধান ও ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়াামির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা ছিল। শিলাইদহে অব¯’ানকালে তার গীতিকবিতার জন্য একটি শব্দবন্ধ তিনি গ্রহণ করেন বাউল পদাবলি থেকে – মনের মানুষ। ধ্যান করেন তার জীবন দেবতার। প্রকৃতি ও মানবচরিত্রের আবেগময় নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে এই যোগসূত্রটি পরমসত্তার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ভানুসিংহের নামাঙ্কিত কবিতাগুলিতেও কবি এই শৈলীর ব্যবহার ঘটান। এই সময়টি ছিল পুরোভাবেই শিলাইদহের।
অন্যদিকে, মনে করা হয় রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির মধ্যে সবথেকে বেশী প্রভাব বিস্তারকারী হলো তাঁর প্রায় ২৫০০০টি গান। রবীন্দ্রসংগীত নামে পরিচিত এই গীতিগু”ছ বাংলার সংস্কৃতির একটি অবি”েছদ্য অঙ্গ। বলা হয় থাকে তার গান সকল প্রকার মানবিক আবেগকেই সুরবদ্ধ করেছে যা সাধারণ স্তর থেকে উ”চ যে কোন স্তরে প্রবেশগম্যতা সহজ করেছে। এটি অনন্য ; অন্য যে কোন গানের ধারাতে নেই।
মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় এই প্রসঙ্গে লেখা হয়, “বাংলায় এমন কোনো শিক্ষিত গৃহ নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া বা অন্ততপক্ষে গাওয়ার চেষ্টা করা হয় না… এমনকি অশিক্ষিত গ্রামবাসীরাও তাঁর গান গেয়ে থাকেন। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে রবীন্দ্রনাথেরই রচনা। আমার সোনার বাংলা রচনায় শিলাইদহের পল্লী কবি গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে’ সহজেই রবী প্রতিভায় ভিন্নভাবে উদ্বাসিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ‘পদ্মাপ্রবাহচুম্বিত শিলাইদহ’ থেকে ইন্দিরা দেবীকে একবার লিখলেন: পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। এই-যে ছোটো নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতি রাত্রে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে , জগৎ-সংসারে এ-যে কী একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়। (‘ছিন্নপত্রে’র ১০ নম্বর চিঠি)।
কলকাতা হয়তো কবির শিল্পিসত্তাকে অনুভব-আবিষ্কার করতে দিয়েছিল কিন্তু সেই বৈভবপূর্ণ প্রাসাদের বাইরে শিলাইদহের গ্রামীণ নৈসর্গিক জনপদে জগত ও জীবনকে নবরূপে অন্তরঙ্গভাবে উপলব্ধি করেছিলেন কবি। তাঁর কাব্যের স্বকীয়তা আর অভিনবত্ব বেশী ধরা দিয়েছিল ‘সোনার তরী’র মতো বহমানতা থেকে।
শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথের আবেগের উপর তাৎপর্যপূর্ণ এক রেখাপাত করেছিল। সেটি বোঝা যায় যখন তিনি বলেন : আমি শীত গ্রীষ্ম বর্ষা মানিনি, কতবার সমস্ত বৎসর ধরে পদ্মার আতিথ্য নিয়েছি, বৈশাখের খররৌদ্রতাপে, শ্রাবণের মুষলধারাবর্ষণে। পরপারে ছিল ছায়াঘন পল্লীর শ্যামশ্রী, এ পারে ছিল বালুচরের পান্ডুবর্ণ জনহীনতা, মাঝখানে পদ্মার চলমান স্রোতের পটে বুলিয়ে চলেছে দ্যুলোকের শিল্পী প্রহরে প্রহরে নানাবর্ণের আলোছায়ার তুলি। এইখানে নির্জনসজনের নিত্যসংগম চলছিল আমার জীবনে। অহরহ সুখদুঃখের বাণী নিয়ে মানুষের জীবনের বিচিত্র কলরব এসে পোঁছাচ্ছিল আমার হৃদয়ে। মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল। তাদের জন্য চিন্তা করেছি, কাজ করেছি, কর্তব্যের নানা সংকল্প বেঁধে তুলেছি, সেই সংকল্পের সূত্র আজও বিচ্ছিন্ন হয়নি আমার চিন্তায়। সেই মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হতে আরম্ভ হলো আমার জীবনে। আমার বুদ্ধি এবং কল্পনা এবং ই”ছাকে উন্মুখ করে তুলেছিল এই সময়কার প্রবর্তনা (“সূচনা”, ‘সোনার তরী’)।
১৮৮৯ সালে ত্রিশ বছর বয়সে কবি-জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি পরিদর্শনের দায়িত্ব নিয়ে আসেন শিলাইদহের নতুন কর্মতীর্থে। তিনি কুঠিবাড়িতে বসবাসের পাশাপাশি পদ্মায় বোটে বসবাস করতেন। দীর্ঘ দশ বছর পর ১৮৯৯ সালে তিনি স্ত্রী ও পুত্র-কন্যা নিয়ে বর্তমান কুঠিবাড়িতে সংসার পাতেন এবং একাদিক্রমে দুই বছর এখানে অব¯’ান করেন। কমর্জ ীবনে রবীন্দ্রনাথ দু’দশকেরও বেশি সময় শিলাইদহে ছিলেন। অবশ্য তাঁর এই বসবাস একটানা ছিল না। তাঁর বসবাস ও সাহিত্য-সাধনার অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে শিলাইদহ ইতিহাসখ্যাত হয়েছে। দীর্ঘ জমিদারি জীবনের পাশপাশি তাঁর কাব্য ও সাহিত্য জীবনের কর্মকাÐ চলেছে সমান্তরাল গতিতে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহকে তাঁর ‘যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্য-রস-সাধনার তীর্থ¯’ান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
শিলাইদহে বসবাস ও জমিদারি পরিচালনাকালে তিনি তাঁর বিপুল সৃষ্টিতে সাহিত্য ভাÐার সমৃদ্ধ করেন।
অনাদি-অনন্ত মহাকালব্যাপী চিরবহমান জীবনপ্রবাহে জন্মান্তরে বিশ্বাসী রবীন্দ্র বারবার ফিরতে চেয়েছিলেন এখানেই। লিখছেন শিলাইদহ থেকে: আমি প্রায় রোজই মনে করি, এই তারাময় আকাশের নীচে আবার কি কখনও জন্মগ্রহণ করব! আর কি কখনও এমন প্রশান্ত সন্ধ্যাবেলায়, এই নিস্তব্ধ গোরাই নদীটির উপর, বাংলাদেশের এই সুন্দর একটি কোণে এমন নিশ্চিন্ত মুগ্ধ মনে জলিবোটের উপর বিছানা পেতে পড়ে থাকতে পাব! হয়তো আর কোনো জন্মে এমন একটি সন্ধেবেলা আর কখনও ফিরে পাব না। তখন কোথায় দৃশ্যপরিবর্তন হবে-আর, কিরকম মন নিয়ে বা জন্মাব। এমন সন্ধ্যা হয়তো অনেক পেতেও পারি, কিš‘ সে সন্ধ্যা এমন নিস্তব্ধ ভাবে তার সমস্ত কেশপাশ ছড়িয়ে দিয়ে আমার বুকের উপরে এত সুগভীর ভালোবাসার সঙ্গে পড়ে থাকবে না। আমি কি ঠিক এমনি মানুষটি তখন থাকব! (‘ছিন্নপত্র’: ৮৪)।
পুত্র রথীন্দ্রনাথ পিতৃস্মৃতি তর্পণ করতে গিয়ে বলেছেন, “গবেষক জীবনচরিত-লেখকেরা সঠিক খবর দিতে পারবেন, তবে সাধারণভাবে আমার ধারণা, বাবার গদ্য ও পদ্য দুরকম লেখারই উৎস যেমন খুলে গিয়েছিল শিলাইদহে, এমন আর কোথাও হয়নি।” ‘সোনার তরী’ থেকে ‘চিত্রা’, ‘ক্ষণিকা’, ‘খেয়া’, ‘বলাকা’ ‘গল্পগু”ছ’, ‘চোখের বালি’, ‘গোরা’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতিমাল্য’, ‘গীতালী’ কিংবা ‘গীতাঞ্জলী’ রচনা ও অনুবাদ- এসব বাদ দিলে কোন রবীন্দ্রনাথ অবশিষ্ট থাকে? পূর্বে থাকে বয়ঃসন্ধির চঞ্চলময় চিত্তের অভিব্যক্তি, পরে থাকে স্মৃতিকাতরতা আর আসন্ন জীবনাবসানের অভিজ্ঞান-উপলব্ধি। সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথই আমাদের শ্রদ্ধেয়, তবে যৌবন-প্রৌঢ়ের রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রিয়, বিশ্ববাসীর সম্মানিত।
শুধু কাব্যরসের ধারাতেই তিনি মশগুল ছিলেন তা নয় এই শিলাইদহে তিনি ছিলেন কর্মযোগী পুরুষও। আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ, নতুন নতুন ফল-ফসলের চাষাবাদ, দাতব্য চিকিৎসালয় ¯’াপন, স্বে”ছাসেবী ‘কিশোর ব্রতী-বালক দল’ ও ‘কর্মীসঙ্ঘ’ গঠন, পল্লীসমাজের সার্বিক উন্নয়নে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ. স্কুল-ক্লাব-চিকিৎসালয় নির্মাণ সাপেক্ষে আদর্শ গ্রাম তৈরি, জমিদারি শাসন সংস্কার করে মন্ডলী প্রথা প্রবর্তন, রায়ত-চাষাদের নিয়ে সমবায় আন্দোলন, গ্রামীণ মেলার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, তাঁতশিল্প প্রসারে বিদ্যালয় ও কারখানা ¯’াপন, লোকসাহিত্য সংগ্রহ, লোকসংস্কৃতি সংরক্ষণ- অনেক কিছু। এবং এই কর্মযোগের ধারাবাহিকতাই ছিল শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন। শিল্পি যে শুধুই শিল্পী হবেন না, তাঁরও যে সামাজিক দায়িত্ব আছে এবং সেটা বহুমাত্রিকভাবে কালোত্তীর্ণ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে।
জাতিয় পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী উদযাপন/
চারবছর পর কুষ্টিয়ার শিলাইদহে জাতিয় পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী উদযাপন হচ্ছে । সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয় কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহায়তায় তিনি দিনের একটি কর্মসূচী উদ্ধোধন করবেন জাতিয় সংসদের স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরী। তিনদিনের অনুষ্ঠানমালায় থাকছে আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জাতিয় ও স্থানীয় পর্যায়ের রবীন্দ্র শিল্পী ও বক্তারা তিনিদিনের আয়োজনে অংশ নিচ্ছেন।
ড. আমানুর আমান, এমফিল (ইবি), পিএইচডি (এনবিইউ-দার্জিলিং), সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক কুষ্টিয়া ও দি কুষ্টিয়া টাইমস, ইংরেজী-বাংলা গবেষক। লিখিত গ্রন্থ সংখ্যা ২৪।
Leave a Reply