December 22, 2024, 9:13 am
ড. আমানুর আমান/সম্পাদক, দৈনিক কুষ্টিয়া/
বাংলা সাহিত্যে কবিতায় অনেকখানী জায়গা নিয়ে প্রেম, দ্রোহ ও বিরহের যে অনুসঙ্গ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সেখানে অন্যতম। তারুণ্য ও সংগ্রামেরও পরিচিত এক প্রতীক কবি রুদ্র। সাম্যবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহ্যচেতনা, দেশাত্মবোধ, ও অসাম্প্রদায়িকবোধেও উজ্জ্বল তিনি ও তার কবিতা। নিজ কণ্ঠে কবিতা পাঠের মাধ্যমে কবিতাকে শ্রোতৃপ্রিয় করে তোলার উদ্যোক্তা কারিগড়দের মধ্যেও অগ্রগণ্য ছিলেন কবি রুদ্র। বাংলাদেশের কবিতায় সত্তর দশকে কবিতার যে শিল্পমগ্ন উচ্চারণ রুদ্র সেখানে প্রবলভাবে স্বীকৃত। বাংলা কবিতায় যখন শব্দে ও মননে সৃজনশীলতা এবং কবিতা সৃষ্টিতে প্রতিভার আবহ অন্বেষণ করা হয় সেখানে রুদ্র জ্বলজ্বলে একটি নাম।
আজ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ৬৫তম জন্মবার্ষিকী। তাকে বাংলা সাহিত্যের আরেক ক্ষণজন্মা কবি বলা হয়। কারন সৃষ্টির বৈভবে অনেক উচ্চতা থাকলেও জীবনের ব্যাপ্তিতে তিনি ছিলেন অল্প-স্থায়ী।
১৯৫৬ সালের আজকের এই দিনে (১৬ অক্টোবর) বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রুদ্র।
রুদ্রের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। লেখালেখির জগতে এসে নামে বদল ঘটান। সেখানেও শিল্পী সত্তার পরিচয় মেলে। নামের আগে যোগ করেন ‘রুদ্র’, ‘মোহাম্মদ’-কে করেন ‘মুহম্মদ’ আর ‘শহীদুল্লাহ’-কে ‘শহিদুল্লাহ’।
ষাটের দশক ছিল রুদ্রের শৈশব-কৈশর। তবে এ শৈশব-কৈশর নিছক বয়সে বেড়ে ওঠা ছিল না। রুদ্র বেড়ে উঠেছিলেন অনেকটা আয়োজন করে যেখানে রুদ্রের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি আর লেখালিখিতে আগ্রহ দুটোই তৈরি হয়। শৈশবেই তার হাতে সে সময় ঢাকার বিখ্যাত ‘বেগম’ আর কলকাতার ‘শিশুভারতী’ পত্রিকা। একই সাথে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল। রুদ্র ডুবে যান এসবের মধ্যে। যখন মংলা থানা সদরের সেইন্ট পলস স্কুলে রুদ্র ৯ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন তখন মুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ শেষে রুদ্র ১০ম শ্রেণিতে ভর্তি হন ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে। এখান থেকেই ১৯৭৩ সালে বিজ্ঞান শাখা থেকে এসএসসি পাস করেন রুদ্র। এরপরে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। পিতামাতার ইচ্ছা ছিল রুদ্র ডাক্তার হোক। কিন্তু রুদ্র চলে যান মানবিক শাখায়।
ঢাকা কলেজে এসে রুদ্র নেমে পড়েন সাহিত্যচর্চায়। সাথে ছিলেন কামাল চৌধুরী, আলী রিয়াজ, জাফর ওয়াজেদ, ইসহাক খানদের মতো একঝাঁক সাহিত্যকর্মী। ঢাকা কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ। সেখান থেকেই অনার্সসহ এমএ।
ছাত্রজীবনেই রুদ্রের দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, ‘উপদ্রুত উপকূল’ আর ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’। দুটি বইয়েরই প্রকাশক ছিলেন আহমদ ছফা। দুটি বইয়ের জন্যেই রুদ্র ১৯৮০ ও ১৯৮১ সালে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন।
মাত্র ৩৫ বছরের (১৯৫৬-১৯৯১) স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং অর্ধ শতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেন। ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’ গানের জন্য তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি প্রদত্ত ১৯৯৭ সালের শ্রেষ্ঠ গীতিকারের (মরণোত্তর) সম্মাননা লাভ করেন।
এই স্বল্প জীবনের পুরো সময় ঘিরেই লেখালেখি আর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে মুখর ছিলেন রুদ্র। তিনি ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৭৫ সালের পরের সবকটি সরকার বিরোধী ও স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন তিনি। কবিতায় উচ্চারণ করেন প্রতিবাদ। রুদ্রের কবিতাগুলো এ সময়ের বাস্তবতায় হয়ে উঠেছিল ‘দুঃখিণী র্বণমালায়’ এক অবিনাশী প্রতিবাদের ভাষা ; সংগ্রামের হাতিয়ার।
প্রথাগত জীবনকে অনেকটা পাশ কাটিয়ে চলতে পছন্দ করা কবি এক পর্যায়ে ঘরও বাঁধেন। কিন্তু ছকবদ্ধ জীবনের হাতছানি তাকে সরিয়ে দেয় যুথবদ্ধ যৌথজীবনের সংঘাত থেকে। তবে এসবের কোনটিতেই ঔদ্ধত্য ছিল না বিপরীতে সেটি ছিল স্বাধীন ব্যক্তি-সংঘাতের সাথে নিবিড় পক্ষপাতিত্ব। এসব তার কবিতাতেও এসছে। রুদ্রের কবিতার যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সেটা জীবনের দ্বন্দ্ব সংঘাত কবিতায় অথবা কবিতার দ্বন্দ্ব সংঘাত জীবনে এভাবে বলে দেয়া সহজ হলেও সমীকরণ অনেকটা প্রকৃতিগত। কারন রুদ্রের প্রকৃতিই ছিল সেটা। রুদ্রের এই ব্যক্তি-সংঘাত ছিল স্বয়ং তার আত্মার সাথে একটি বোঝাপড়া। যেখানে সংশয় ছিল প্রগাঢ়ভাবে। যে সংশয় পুরোটাই ছিল ইতিবাচক। যেখানে তিনি খুঁজে ফিরেছেন “বিশ্বাসের মতো বিশ্বাসী মানুষ।” তার উচ্চারণ ছিল
“বহুদিন ধরে খুঁজছি এখনো আজো
একজন বিশ্বাসী মানুষ খুঁজছি—
বড় একাকী আছি আমি
অথবা
বুকজুড়ে থাকা একজন মানুষ
সবকিছু থেকে ফিরে এসে এই নির্জনতা
এইভাবে শুধু নিজের ভেতরে নিজেকে সাজানো
বেদনার সাথে একা একা বোসে নিজেকে হারানো——-।
রুদ্র নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছিলেন সকল শ্রেণীর মানুষের আত্মার সঙ্গে। সাম্যবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহ্যচেতনা ও অসাম্প্রদায়িকবোধে উজ্জ্বল তার কবিতা। সমতার সংগ্রাম ছিল তার আজন্ম। অন্যদিকে সমাজ ভাঙার গানও ছিল রুদ্রের কবিতার উপজীব্য। সমাজের দ্বন্দ্ব সংঘাত কবিতার উপজীব্য হয়ে দেখা দিলে যেটা উঠে আসে, রুদ্রের কবিতায় সেই পরম্পরা খুব তীব্র ও সক্রিয়ভাবেই এসেছে। এক্ষেত্রে শব্দের সংকীর্ণতায় কখনো ভোগেননি রুদ্র। ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’- এত নির্মম সত্য কথা বাংলা কবিতায় শোনা গেছে বহুদিন পর। একই সাথে তার চিন্তাজুড়ে, শব্দজুড়ে ছিল শুধু স্বপ্ন, প্রেম ও সুন্দরের সমগ্রতা যখন বলতে শুনি ‘দিন আসবেই- দিন সমতার’।
Leave a Reply