November 3, 2024, 2:13 am
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক আবু হাসানুজ্জামানের অনিয়মের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। হাসপাতলের জন্য ওষুধ, যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন ক্রয়ে পুকুর চুরি করেছেন তিনি। তার সহযোগী ছিল আরো দুই জন। দুই বছরের তত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালনের সময় কোটি টাকার উপর লুটপাট করেছেন তিনিসহ এই তিন জন।
এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে দুদকের কুষ্টিয়া সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে নথি উপস্থাপন করেছেন। মামলাটি রেকর্ড হয়েছে কুষ্টিয়া জেলা কার্যালয়ে। সেখানে এনব অনিয়মের হাসানুজ্জামান আরো দুই জনের নাম এসেছে তারা হলেন ন্যাশনাল ইলেকট্রো মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কসপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) মহাখালী কার্যালয়ের সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট রিপিয়ার কাম ট্রেনিং ইঞ্জিনিয়ার এ এইচ এম আব্দুল কুদ্দুস (৬১) ও রাজশাহীর কেশবপুর মোড় এলাকার প্যারাগন এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর মো. জাহেদুল ইসলাম (৩২)।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহের দরপত্র আহ্বানের আগে মেডিকেল যন্ত্রপাতির বাজার দর যাচাই না করে অধিক দরে কার্যাদেশ দেন। পরে মেডিকেল যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে এর মূল্য বাবদ সরকারের অতিরিক্ত ১ কোটি ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭০ টাকা ক্ষতিসাধনপূর্বক পাঁচটি বিলের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন ও আত্মসাৎ করেন। এতে অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
দুদকের তদন্তে দেখা গেছে তত্বাবধায়কসহ ঐ তিনজন পরস্পর যোগসাজশে ১৭ লাখ টাকার অ্যানেসথেসিয়া মেশিন ৭১ লাখ টাকায় ক্রয় দেখিয়েছেন। যা বাজারদরের চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি। দুটি মেশিন ক্রয় করা হয়। ১৭ লাখ ১৮ হাজার ২১৫ টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি অ্যানেসথেসিয়া মেশিন ক্রয় করা হয়েছে ৭১ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। দুটি অ্যানেসথেসিয়া মেশিন ক্রয়ে অতিরিক্ত ৩৪ লাখ ৩৬ হাজার ৪৩০ টাকা খরচ করা হয়েছে।
শুধু অ্যানেসথেসিয়া মেশিন নয় আইআরআর মেশিনসহ আরও বহু যন্ত্রপাতি তারা তিনগুণ মূল্যে ক্রয় দেখিয়েছেন। দেশের বাজারে প্রতিটি আইআরআর মেশিনের মূল্য ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। অথচ তারা এই মেশিন ৬ লাখ টাকায় ক্রয় দেখিয়েছেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের জন্য প্যারাগন এন্টারপ্রাইজ থেকে অস্বাভাবিক দামে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়।
দুদক সূত্র জানায়, সাধারণ ব্যথা, ঘাড় ব্যথা, পেশী ব্যথার চিকিৎসার জন্য টেনস মেশিন ব্যবহার করা হয়। যার বাজার মূল্য ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। কিন্তু ক্রয় দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। দুটি টেনস মেশিন ক্রয়ে অতিরিক্ত ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে।
৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি ইলেক্ট্রোসার্জিক্যাল কেটারি মেশিন ক্রয় করা হয়েছে ৭ লাখ টাকায়। একটি ইলেক্ট্রোসার্জিক্যাল কেটারি মেশিন ক্রয় করে অতিরিক্ত ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি আইআরআর মেশিন ক্রয় করা হয়েছে ৬ লাখ টাকায়। পাঁচটি আইআরআর ক্রয়ে অতিরিক্ত ১৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে।
দাঁতের চিকিৎসার জন্য ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি ডেন্টাল ইউনিট মেশিন ক্রয় করা হয়েছে ৪৮ লাখ টাকায়। একটি ডেন্টাল ইউনিট মেশিন ক্রয়ে অতিরিক্ত ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮২৫ টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি ডায়াথার্মি মেশিন ক্রয় করা হয়েছে ১১ লাখ ১০ হাজার টাকায়। চারটি ডায়াথার্মি মেশিন ক্রয়ে অতিরিক্ত ২৫ লাখ ২৮ হাজার ৭০০ টাকা খরচ করা হয়েছে।
১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি বৈদ্যুতিক স্নায়ু উত্তেজক যন্ত্র ক্রয় করা হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকায়। দুটি বৈদ্যুতিক স্নায়ু উত্তেজক যন্ত্র ক্রয়ে অতিরিক্ত ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। ১ লাখ ৩৯ হাজার ৪০ টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি পালস অক্সিমিটার ক্রয় করা হয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। চারটি পালস অক্সিমিটার ক্রয়ে অতিরিক্ত ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৮৪০ টাকা খরচ করা হয়েছে। ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি ইসিজি (১২ চ্যানেল) ক্রয় করা হয়েছে ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। পাঁচটি ইসিজি ক্রয়ে অতিরিক্ত ২২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে।
১০ লাখ ৯০ হাজার টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি পেসেন্ট মনিটর ক্রয় করা হয়েছে ১২ লাখ টাকায়। পাঁচটি পেসেন্ট মনিটর ক্রয়ে অতিরিক্ত ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। এই যন্ত্রটি ব্যবহার করে রোগীর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যকলাপ পরিমাপ করা হয়।
দরপত্রের দরে গৃহীত যন্ত্রপাতির মোট দাম ধরা হয়েছিল ৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। বাজারমূল্য অনুযায়ী যন্ত্রপাতির দাম হয় ২ কোটি ৫০ লাখ ১৬ হাজার ৩০ টাকা। বাজার মূল্যের চেয়ে দরপত্রের মূল্যের পার্থক্য ১ কোটি ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৯৭০ টাকা। পার্থক্যের ১ কোটি ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৯৭০ টাকা থেকে ভ্যাট বাবদ ৫ শতাংশ, আয়কর বাবদ ৬ শতাংশ এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাভ বাবদ ১৫ শতাংশ মোট ২৬ শতাংশ হিসেবে ৩৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকা বাদ দিলে দাঁড়ায় ১ কোটি ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭০ টাকা। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১ কোটি ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন আসামিরা।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ডা. এম এ মোমেন রাতে জানান তিন মাস আগে এই হাসপাতালে যোগদান করেছেন। তিনি বলেন অপরাধ যেই কওে থাকুক তার শাস্তি হতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক আবু হাসানুজ্জামানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। মেসেজ পাঠিয়ে পরিচয় দেয়া সত্বেও তিনি তিনি কোন সাড়া দেননি।
দুদকের কুষ্টিয়া সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক জাকারিয়া জানান প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় দুদকের প্রধান কার্যালয় মামলার অনুমতি দিয়েছে। এখন পূর্ণ তদন্ত শুরু হবে।
Leave a Reply