হুমায়ুন কবির, খোকসা/
সময়ের ভারে অনেকটাই নূ্যব্জ ৭৬ বছর বয়সী হাসিনা বেগম। কথায় কথায় জানালেন, ছেলের খুনিদের বিচারের রায় বাস্তবায়ন না দেখে মারা যেতে কিছুতেই রাজি নন তিনি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াল গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছেন তার সন্তান মাহবুবুর রশীদ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্স করপোরাল মাহবুব। ছেলে মাহবুবের সমাধির উন্নয়ন ছাড়া আর কোনো প্রত্যাশা নেই তার বাবা হারুন অর রশীদের।
প্রতি বছর ২১ আগস্ট এলে টেলিভিশনে ১৮ বছর আগেকার নৃশংস গ্রেনেড হামলার দোষীদের শাস্তি বাস্তবায়নের নানা খবর শোনেন হাসিনা বেগম। মাঝে মাঝে রায় বাস্তবায়নের আশার আলোও দেখেন। কিন্তু দিবসটি গেলেই সবাই যেন ভুলে যায় সব কিছু। কিন্তু তিনি কী করে ভুলবেন! ছেলের খুনের বিচার চান মা হাসিনা বেগম এবং বাবা হারুন অর রশীদ; তা ছাড়া চান মাহবুবের সমাধিটিকে যেন সংরক্ষণ করা হয় ভালোভাবে।
কুষ্টিয়ার খোকসার জয়ন্তী হাজরা ইউনিয়নের ফুলবাড়িয়া গ্রামে নিজের ঘরের বিছানায় বসে নিজের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা বলছিলেন হাসিনা বেগম। তিনি জানালেন, শারীরিক অবস্থা ভালো নয় তার। এখন আর বেশি ভাবতেও পারেন না। বুকের মধ্যে 'ধরপর' করে ওঠে। কথায় কথায় জানালেন, মাহবুবুর রশীদের স্ত্রী তাদের খোঁজখবর নিয়মিতই রাখেন। মাহবুবুরের দুই ছেলে আশিক ও রবিনকে নিয়েও স্বপ্ন দেখেন হাসিনা। তারা বড় হয়ে বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে-এটাই প্রত্যাশা তার।
সংসারের উপার্জনক্ষম ছেলে মাহবুবুর রশীদ ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের শান্তি সমাবেশে ভয়ানক গ্রেনেড হামলায় নিহত হওয়ার পর থেকে তিনি অপেক্ষা করছেন, দোষীদের বিচার ও সাজা হবে। যদিও সে আশা আর বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
বৃদ্ধ হাসিনা বেগমের কাছে কোনো হিসাবই এখন আর বড় নয়। তিনিও স্বামী হারুনের মতো ছেলের সমাধিস্থল সংরক্ষণের ও কবরস্থানে বিদ্যুতের আলোর ব্যবস্থা করার দাবি জানান। করোনাভাইরাসের সংকটময় পরিস্থিতিতেও নিহত মাহবুবুর রশীদের বাবা-মা কোনো সরকারি সাহায্য পাননি। উল্টো স্থানীয় নেতারা তার পরিবারকে 'রাজাকার পরিবার' আখ্যা দিয়েছেন। এতে কষ্ট পেয়েছেন তারা। তবে কোনো প্রতিবাদও করেননি।
বাবা হারুন অর রশীদ জানান, একসময় বিড়ি তৈরির কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন। শত অভাবের মধ্যেও তার ১০ সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ করেননি। দ্বিতীয় ছেলে মাহবুবকে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার জয়ন্তী হাজরা ইউনিয়নের ফুলবাড়িয়া গ্রামের বাড়ির পাশের ফুলবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করলে তিনি সেখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন। কিন্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা না থাকায় তাকে মামা আবদুর রব নিয়ে গিয়ে রাজবাড়ীর পাংশার বাহাদুরপুর শহীদ খবির উদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। মামাবাড়ি থেকেই ১৯৮৪ সালে এসএসসি পাস করেন মাহবুব। তারপর সংসারের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীর মেজর পর্যায়ের এক কর্মকর্তার বাসায় ৬০০ টাকা বেতনে চাকরি নেন মাহবুব। পরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পান।
মাহবুবের চাকরিতেই দরিদ্র সংসারটিতে আশার প্রদীপ জ্বলে ওঠে। পাঁচ বোনের তিন বোনকে বিয়েও দেন। নির্দিষ্ট মেয়াদে চাকরি শেষে গ্রামে ফিরে ব্যবসার উদ্যোগ নেন তিনি। তাতে ভালো না হওয়ায় আবার চাকরির সন্ধান করতে থাকেন।
এরই মধ্যে মাহবুব তার সতীর্থ সৈনিকদের মাধ্যমে খবর পেয়ে ২০০০ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। পরে বিশ্বস্ততা অর্জন করায় অল্প সময়ের মধ্যে নেত্রীর ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর দায়িত্বও পেয়ে যান। মাহবুব তার স্ত্রী শামীমা আক্তার আসমা এবং দুই ছেলে আশিক ও রবিনকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে সফল সৈনিক ছিলেন। মৃত্যুর দুই মাস আগে বাড়ি এসে বাবার অজুর জন্য টিউবওয়েল বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। পরের ছুটিতে টিউবওয়েলের গোড়া পাকা আর শোবার ঘরের অসমাপ্ত বেড়া মেরামত করার কথা ছিল তার।
কিন্তু ২১ আগস্টের ঘাতকদের বুলেট তার সব স্বপ্ন কেড়ে নেয়। মাহবুব বাড়ি ফেরেন সাদা কাফনে মোড়ানো অবস্থায়। তাকে সমাহিত করা হয় তার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত ফুলবাড়িয়া স্কুলের পাশে।
এবারও ছেলের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নিজের বাড়িতে মিলাদ মাহফিলের ব্যবস্থা করেছেন হারুন অর রশীদ। তিনি জানান, প্রতি মাসে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহতদের জন্য গঠিত কল্যাণ ফান্ড থেকে যে টাকা দেওয়া হয়, তা দিয়ে দু'জনের সংসার চলতে চায় না। তাই তিনি বাড়িতে লালনপালন করা গাভির দুধ বিক্রির টাকা থেকে ছেলের মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য কিছু টাকা জমিয়ে রাখেন।