December 22, 2024, 10:07 am
জহির রায়হান সোহাগ/
ষাটোর্ধ কহিনুর বেগম। তার স্বামী ছামছদ্দিন মন্ডল হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন ২৫ বছর আগে। তখন তার ৪ মেয়ে খুব ছোট ছিল। সেই থেকে শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। ভূমিহীন কহিনুর বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করে তার মেয়েদের বড় করেছেন। খুব কষ্টে তিনি তার ৪ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন তিনি। বিধবা ভাতার টাকা ও খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির চালে চলে তার একার সংসার। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের কহিনুর বেগম এখন আর ভূমিহীন নন। সরকারিভাবে পেয়েছেন জমি ও রঙিন বাড়ি।
কহিনুর বেগম বলেন, আমাদের কুনু জমি ছিলু না। বিয়ির পর আমরা খড়ের ঘরে থাকতাম। একুন জমি ও নতোন ঘর পেয়ি খুব ভাল লাগচি। শেষ বয়সে একটা ভবিষ্যৎ হলু আমার। এ জন্যি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যুবাদ।
নতুন বাড়ি পেয়েছেন একই গ্রামের স্বামী পরিত্যক্তা মনজুরা খাতুন। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তার বসবাস। হোটেলে কাজ করে সংসারের কাজে সহায়তা করে তার ছেলে।
মনজুরা খাতুন বলেন, আমার স্বামী ছেড়ি দিয়ার পর ছেলিকে নিয়ি খুব কষ্টে আচি। আমাদের কুনু জমি-জায়গা নেই। ছেলি কাজ করি আমাকে সাহায্যু করে। আমি পরের বাড়িতে কাজ করি।
তিনি আরও বলেন, সরকারের দিয়া নতুন ঘর পেয়ি খুব খুশি আমি। ঘরটা খুব সুন্দর লাগচি। শেখ হাসিনা বেচি থাক এই দুয়া করি।
কথা হয় পাশের বাড়ির মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মাহফুজ সরদারের সাথে। তিনি বলেন, আমরা তিন ভাই-বোন। বাবা ও বড় ভাই দিন মজুর। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আমি এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেব। আমাদের খড়কুটোর ঘর ছিল। সেখানে আমি ভালভাবে লেখাপড়া করতে পারতাম না। বৃষ্টির সময় চাল ফুটো হয়ে পানি পড়তো। শীতেও খুব কষ্ট হতো। এখন নতুন ঘর পেয়ে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। সরকারের এমন ভাল উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান মাহফুজ।
একই গ্রামের দিনমজুর ইকরামুল হক আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, এতদিনে আমার মাতা গুজার ঠাই হলু। বউ ও ছেলিকে নিয়ি নতুন ঘরে উটিচি। খুব ভাল লাগচে।
বোয়ালিয়া গ্রামে ১৫টি পরিবার পেয়েছে সরকারের দেয়া জমি ও নতুন রঙিন বাড়ি। গতকাল বিকেলে ওই গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একসারিতে থাকা হালকা সবুজ ও হালকা লাল রঙের টিনের ছাউনি দেয়া বাড়িগুলো দেখে ধাঁধিয়ে যাবে যে কারও চোখ। নতুন বাড়ি পেয়ে আনন্দে খুনসুটিতে মেতেছেন বয়স্করা। একসারিতে থাকা রঙিন ঘরে নতুন প্রতিবেশী পেয়েছেন তারা। তাই একে অন্যের সাথে করছেন আতিথেয়তা। উল্লাস করছে শিশু-কিশোররাও। দিনটি যেন তাদের কাছে ঈদের দিন। রঙিন বাড়ি দেখতে আসছেন গ্রামের অনেকেই।
এদিকে, সারাদেশের মতো চুয়াডাঙ্গাতেও ভূমিহীন ও গৃহহীন জমি ও গৃহ হস্তান্তর করা হয়েছে।
গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ওই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলার ১৭৫ জন ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ১৭৫টি নতুন বাড়ি ও জমির দলিল হস্তান্তর করা হয়। জমির দলিল ও বাড়ির চাবি হস্তান্তর করেন চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ারর্দার ছেলুন।
এসময় চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ারর্দার ছেলুন বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি স্বপ্ন দেখতেন দেশের সকল মানুষ অন্ন ,বস্ত্র, আশ্রয় এবং উন্নত জীবন পাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পিতার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করছেন।
জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার জানান, ভূমিহীন ছাড়া অন্য কেউ এ বাড়ি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখানে রাজনৈতিক কোন প্রভাবও নেই। উপজেলা পর্যায়ে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটি ভূমিহীন ও গৃহহীনদের নামের তালিকা তৈরী করেছেন।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ১৭৫ জন ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ১৭৫টি নতুন বাড়ি ও জমির দলিল প্রদান করা হয়েছে। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ৫০টি, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৪৫টি, দামুড়হুদা উপজেলায় ৩০টি এবং জীবননগর উপজেলায় ৫০টি বাড়ি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিারের মাঝে হস্তান্তর করা হয়। এবারে প্রতিপাদ্য ‘আশ্রয়নের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে আরও জানা গেছে, গত আড়াই মাস আগে চুয়াডাঙ্গা জেলায় প্রথম পর্যায়ে ১৩৪টি বাড়ি ১৩৪ জন ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মাঝে জমি ও গৃহ প্রদান করা হয়। ওই সময়ে প্রতিটি বাড়ির জন্য দুই শতক জমি এবং রঙিন টিনের দুটি ঘর, একটি রান্নাঘর ও একটি বাথরুম বিশিষ্ট বাড়ি নির্মাণ করে দেয়া হয়। প্রতিটি বাড়ি নির্মাণে খরচ হয় ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। এবার দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৭৫টি বাড়ি নির্মাণে প্রতিটি বাড়ির জন্য ব্যয় করা হয়েছে এক লাখ ৯১ হাজার টাকা। প্রতিটি বাড়ি খাস জমিতে করা হয়েছে। এছাড়া, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত ১৫টি পরিবারের জন্য বাড়ি নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৬টি, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৬টি এবং জীবননগর উপজেলায় ৩টি বাড়ি রয়েছে। ক্ষুদ্র-নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির জন্য ২০টি বাড়ি তৈরী করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৫টি, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৫টি, দামুড়হুদা উপজেলায় ৫টি এবং জীবননগর উপজেলায় ৫টি বাড়ি রয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বেসরকারি উদ্যোগে ৩৬টি বাড়ি নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি বাড়ির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২৭টি বাড়ির কাজ শিগগিরই সম্পন্ন হবে।
Leave a Reply