October 30, 2024, 8:01 pm
শাহনাজ আমান/
কুষ্টিয়া চিনিকলের গুদাম থেকে প্রায় ৫৩ টন চিনি দিনের পর দিন অভিনব কৌশলে একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকেই বিক্রি করে দেয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।শিল্প মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন কথা বলেননি। তবে চিনি গায়েবের ঘটনাকে চিনি চুরি বলে অভিহিত করেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির একজন সদস্য।
তিনি বলেছেন ‘প্রকাশ্য দিবালোকেই কিন্তু সবার অগোচরে’ এই দুস্কর্ম সম্পন্ন হয়েছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শিবনাথ রায়কে প্রধান করে গঠিত ৫ সদস্যের এ তদন্ত কমিটি সোমবার (৭ জুন) তদন্ত পরিচালনা করেছেন। তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন- মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম সচিব আনোয়ারুল আলম, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের পরিকল্পনা প্রধান আইনুল হক, উপ-মহাব্যবস্থাপক ইলিয়াছ শিকদার ও ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক হামিদুল ইসলাম।
কুষ্টিয়া চিনিকলে নিজস্ব স্টক স্টেটমেন্টে ১২১ টন চিনি থাকার কথা থাকলেও সেখান থেকে ৫৩ টন উধাও হয়ে যায়। এই চিনির মুল্য প্রায় ৩৩ লাখ টাকা। বিষয়টি প্রথম নজরে আসে ৩ জুন যখন চিনি কলের গুদামের বর্তমান অবস্থা জানতে চিনিকলের চিনিসহ উৎপাদিত অন্য পণ্যের বর্তমান মজুদ, বিক্রয়, আয় প্রভৃতি বিষয় নিয়ে এক বৈঠকে স্টোর কিপার ফরিদুল ইসলাম সামনজস্যহীন তথ্য উপস্থাপন করতে থাকেন। এতে চিনির বর্তমান মজুদ নিয়ে হওয়ায় সন্দেহ দেখা দেওয়ায় তৎক্ষনাৎ চিনি কলের জিএম রাকিবুর রহমান সহ কর্মকর্তারা মিলের গুদাম পরিদর্শনের গিয়ে সেখানে ৫৩ টন চিনির হিসেবে স্পষ্ট গোলমাল পাওয়া যায়। স্টোরকিপার বিষয়টি নিয়ে চাপাচাাপি করলে তিনি হিসেব মেলানোর জন্য শনিবার পর্যন্ত সময় চেয়ে নেন। শনিবারেও তিনি বিষয়টি বুঝিয়ে ব্যর্থ হন। ঐ দিনই স্টোর কিপারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের জন্য কারখানার জিএম (অর্থ) কল্যাণ কুমার দেবনাথকে প্রধান করে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। একই দিন সন্ধ্যায় চিনিকলের চিনি চুরি করে অর্থ লোপাট করা হয়েছে মর্মে একটি সাধারণ ডায়েরী করা হয় কুষ্টিয়া মডেল থানায়।
রবিবার শিল্প মন্ত্রণালয় আরো পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এ কমিটি রবিবার রাতেই কুষ্টিয়া এসে পৌঁছান ও সেমবার থেকে তদন্তে নামে।
কমিটির সূত্র জানায় তারা চিনিকলের চিনিসহ উৎপাদিত অন্য পণ্যের বর্তমান মজুদ, বিক্রয়, আয় প্রভৃতি নথিগুলো খতিয়ে দেখেছেন। গুদাম ও বিভিন্ন ভান্ডারের (স্টোর) দায়িত্বে থাকা বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। অতি সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ১০ জনের বক্তব্য নেয়া হয়েছে।
চিনি চুরি পুরোন নজির রযেছে/
চিনিকলের বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে এই চিনিকলে চিনি চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনার পুরোন নজির রয়েছে।
এর আগে ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর চিনি চুরির দায়ে কুষ্টিয়া চিনিকলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মুর্শেদ, চিনিকলের সিবিএ সভাপতি ফারুক হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমানকে একযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। তারা এখন বরখাস্ত এবং মামলা চলমান। সে সময় চক্রটি প্রায় ৮ টন চিনি চুরি করে বিক্রয় করে দেয় ও মৌসুমী শ্রমিক না নিয়েই শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রচুর অর্থ আত্মসাত করে।
যেভাবে চুরিটি সংঘটিত হয়েছে মনে করা হচ্ছে/
হালের এ ঘটনায় মনে করা হচ্ছে চিনি চুরি হয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। একটি শক্তিশালী অসাধু চক্র এই কাজের সাথে জড়িত।
তদন্ত কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করে জানান চিনি কলে প্রতিদিনই চিনি বিক্রি হয়ে থাকে। ক্রেতারা মিলের বিক্রয় কেন্দ্রে মুল্য পরিশোধ সাপেক্ষে ¯িø্প গ্রহন করে থাকেন। বিক্রয়কৃত চিনির স্লিপ গুদামে পৌঁছানোর পর গুদাম থেকে চিনি বের করা হয়ে থাকে। সেই চিনি মিল গেট থেকে বুঝে নিয়ে থাকেন ক্রেতারা। বিক্রয় ¯িøপের বাইরে চিনিকল গুদাম থেকে চিনি বাইরে আসার সুযোগ না থাকলেও এখানে সেটা ঘটেছে। ¯িøপের বাইরেও বস্তা বস্তা চিনি গুদামের বাইরে এসেছে এবং সেই চিনি বিক্রি হয়ে গেছে ঐ অসাধু চক্রের নির্ধাারিত ক্রেতাদের কাছে। কিন্তু ঐসব চিনি বিক্রি মিলের বিক্রয় বহিতে অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি বলে মনে করা হচ্ছে।
তদন্ত কমিটির ঐ সদস্য জানান এখানে আরেকটি ঘটনা ঘটে তাকতে পারে সেটি হলো গুদামে ভূয়া বিক্রয় স্লিপ তৈরি করে পাঠানোর ব্যাপারটি। যেহেতু ¯িøপের আলোকেই গুদাম থেকে চিনি বাইরে আসে সেহেতু বিশ্বাসযোগ্য করা ভূয়া স্লিপ’র সাহায্য নেয়া হতে পারে।
“আমরা সব বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করছি। এর সাথে একটি বড় ও শক্তিশালী চক্র জড়িত এতে কোন সন্দেহ নেই,” তিনি জানান।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও তদন্ত কমিটির প্রধান শিবনাথ রায় সাংবাদিকদের বলেছেন নথিপত্র দেখা হচ্ছে, গোডাউন পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের সারবস্তু মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে আজকের (৮ জুন) মধ্যেই।
চিনিকলের জিএম (অর্থ) কল্যাণ কুমার দেবনাথ যিনি ঘটনায় চিনিকল কতৃপক্ষ কতৃক গঠিত ৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির প্রধান হয়ে তদন্ত করছেন ফোনে জানান একটি চক্র চিনিকলটিকেই জিম্মি করে ফেলেছে। ঘটনার অনেক কিছুই উন্মোচনের অপেক্ষা। বিষয়টি এখনই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ যোগ্য নয়।
কুষ্টিয়া মডেল থানার অফিসার ইন চার্জ সাব্বিরুল আলম জানান চিনিকল কতৃপক্ষের জিডিতে ৫৩ টর চিনি ‘উধাও’ হবার কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি সরকারী বিধায় সেটি দুর্নীতি দমন কুষ্টিয়া সমন্বিত কার্যালয়ে পাটিয়ে দেয়া হয়েছে।
চিনি কলের জিএম (প্রশাসন) রাকিবুর রহমান জানান একটি চক্র সুকৌশলে কাজটি করেছে। যেহেতু উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত চলছে এখানে আমি কিছুই বলতে পারছি না।
বন্ধের পথে ৬০ বছরের পুরোন রাষ্ট্রায়াত্ত এ প্রতিষ্ঠিানটি/
কুষ্টিয়া চিকিল দেশের আর সব বন্ধ অথবা বন্ধের পথে ধুকতে থাকা চিনিকলগুলোর অন্যতম। ইতোমধ্যে বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলেও এখনও কার্যকর হয়নি ৬০ বছরের পুরোনো কুষ্টিয়া সুগার মিলটি।
গত বছরের ২ ডিসেম্বর সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে কুষ্টিয়া চিনিকলসহ ছয়টি মিলের আখ মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে।
২০১৯-২০ মৌসুমেও ৬১ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। চলতি মৌসুম (২০২০-২১) শেষে লোকসানের অঙ্কে কমপক্ষে আরও ৬০ কোটি টাকা যোগ হবে।
আখ মাড়াই বন্ধ থাকা চিনিকলটি ৫৪৫ কোটি টাকা লোকসানে রয়েছে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) খোরশেদ আলম।
অন্যদিকে, কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, মজুরি এবং চাষিদের পাওনা ও বিভিন্ন মালামাল ক্রয়ের বকেয়াসহ দেনার দায় জমেছে ২৪ কোটি টাকার। তিনি বলেন, মিলের এখন স্থায়ী কর্মী ৩৯৬ জন। এর মধ্যে ২৩ জন কর্মকর্তা। বাকিরা কর্মচারী ও শ্রমিক।
তিনি জানান, গত ডিসেম্বরে চিনিকলে মাড়াই বন্ধের সময় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টন চিনি ছিল অবিক্রীত। এখন সেখানে রয়েছে ৭৩৭.৫৫ মেট্রিক টন চিনি। এর অর্থমূল্য প্রায় ৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। কারখানার এ কর্মকর্তা জানান, কলে চিটাগুড় রয়েছে ২ হাজার ২০০ মেট্রিক টন, যার দাম প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এগুলো ডিসেম্বরের পর থেকে আর বিক্রি হয়নি।
জিএম রাকিবুর জানান মিল প্রায় গুটিয়ে ঢেলা হয়েছে। সরকার এটিকে আর চিনিকল হিসেবে চালাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তবে এই মিল এরিয়াসহ মোট ২১৬ একর জায়গায় অন্য কিছু করার চিন্তা করা হচ্ছে। এখানে যাতে ১০ হাজার মানুষ কাজ করতে পারে, সে ধরনের কারখানা করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে’, যোগ করেন তিনি।
তবে চিনিকলের জায়গায় কী করা হবে, তা ঠিক করা হয়নি জানিয়ে রাকিবুর বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ভালো বিনিয়োগকারী খোঁজা হচ্ছে।
কুষ্টিয়া শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে জগতি এলাকায় ১৯৬১ সালে শিল্প প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৯৬৫-৬৬ মৌসুম থেকে কারখানায় চিনি উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার চিনিকলটিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে।
Leave a Reply