দৈনিক কুষ্টিয়া প্রতিবেদক, চুয়াডাঙ্গা/
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারে প্রসূতির সিজার করতে গিয়ে নবজাতকের (কন্যা) ভুঁড়ি বের হয়ে মৃত্যু হয়েছে। প্রসূতি বেঁচে গেলেও একদিন পর মারা যায় সদ্য ভূমিষ্ঠ।
আজ রোববার সকালে বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। আনাড়ি ডাক্তার দিয়ে সিজার করার কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে রোগীর লোকজনের অভিযোগ। প্রসূতি ওই ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন থাকলেও সদ্যভূমিষ্ঠ নবজাতককে ময়না তদন্তের জন্য নেয়া হয়েছে সদর হাসপাতাল মর্গে। ইউনাটেড মেডিকেল সেন্টারের বিরুদ্ধে এর আগেও একাধিক ভুল অপারেশনের অভিযোগ আছে। এমনকি কয়েকবার ক্লিনিকটি বন্ধের নির্দেশও দেয় কর্তৃপক্ষ। তারপরও অবৈধভাবে ক্লিনিকটি চালিয়ে আসছে কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয়রা জানান, আলমডাঙ্গা উপজেলার বাদেমাজু গ্রামের সাগর আলীর স্ত্রী রুমা খাতুনের প্রসব বেদনা উঠলে তাকে গেল শুক্রবার আলমডাঙ্গার ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয়। ওই দিন দুপুরে প্রসূতির সিজার করা হয়। জন্ম নেয় এক কন্যা সন্তান।
প্রসূতি রুমা খাতুনের স্বামী সাগর আলী বলেন, সিজার অপারেশন করার সময় নবজাতকের পেট কেটে গিয়ে নাড়ি ভুঁড়ি বের হয়ে যায়। ওই অবস্থায় আমার সন্তানকে না দেখিয়ে গোপন কক্ষে ৩ ঘন্টা রেখে দেয়া হয়। পরে তার মায়ের কাছে দেয়া হয়। ভূমিষ্ঠের পর নাড়ি ভুঁড়ি বের হয়ে আসার কারণে সন্তানের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। শুক্রবার রাতে তাকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেয় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। আমার সন্তানকে কোনোভাবেই বাঁচানো সম্ভব হয়নি বলে জানিয়ে দেন সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক। পরে আমার সন্তানকে বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসি।
সাগরের ফুফাতো ভাই উজ্জ্বল হোসেন জানান, শনিবার বিকেলে বাড়ি থেকে নবজাতককে আবারও আমরা কুষ্টিয়া সনো সেন্টারে নিয়ে যাই। সেখানে যাওয়ার পর রাতে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। তিনি আরও জানান, আলমডাঙ্গার ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারের মালিক নাজমুল হক নিজেই অপারেশন করেছিলেন। তবে শর্ত অনুযায়ী একজন বিশেষজ্ঞ সার্জনকে দিয়ে সিজার করানোর কথা ছিলো। তারা এটা করলে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতো না।
এ ব্যাপারে ইউনাইটেড ক্লিনিকের মালিক উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার নাজমুল হক বলেন, প্রসূতির অপারেশন করেছেন ডা.বিপাশা। জন্মের সময় ত্রুটির কারণে শিশুর নাড়ি ভুঁড়ি বের হয়ে আসে। এটা ডাক্তারের ত্রুটি নয়। এখানে কারও কিছু করার ছিলো না।
এ ঘটনায় আলমডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর কবীর বলেন, এ ঘটনায় মারা যাওয়া শিশুর পিতা সাগর আলী বাদী হয়ে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এদিকে, এর আগেও ইউনাটেড মেডিকেল সেন্টারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ভুল অপারেশনে একাধিক রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় একাধিক সময়ে ক্লিনিকের সকল কার্যক্রম বন্ধেরও নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। তারপরও তারা অবৈধভাবে ক্লিনিক ব্যবসা চালিয়ে আসছিলো।
একাধিক অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের ৭ মার্চ অপারেশনের পর প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় আলমডাঙ্গার ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারের সকল কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। চুয়াডাঙ্গার তৎকালীর ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. এহসানুল হক তন্ময়ের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত টিম ওই ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। এর দুদিন আগে ৫ মার্চ ২০ কুষ্টিয়া মিরপুরের মালিহাদ ইউনিয়নের রায়পাড়া গ্রামের রহিদুল ইসলামের স্ত্রী ফাতেমা খাতুনের প্রসব বেদনা দেখা দিলে তাকে আলমডাঙ্গার ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয়। ক্লিনিক মালিক নাজমুল ডাক্তারের পরামর্শে রোগীকে রাত ৮টার দিকে অপারেশন করার পর একটি সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু প্রসূতির প্রেসার বেড়ে গেলে তা কমানোর জন্য ইনজেকশন পুশ করা হলে রোগী মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ সময় তাকে এ্যাম্বুলেন্সে তুলে কুষ্টিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। কুষ্টিয়ায় নেয়ার পর প্রসূতি ফাতেমাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
তবে সেসময় রোগীর স্বজনরা বলেন, ক্লিনিকে ফাতেমার মৃত্যুর পর তড়িঘড়ি করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয় ক্লিনিকের লোকজন। এ ঘটনায় তারা মরদেহ নিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারের সামনে অবস্থান নিয়ে বিচার দাবি করেন। ঘটনাটি তদন্তের জন্য চুয়াডাঙ্গার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. এহসানুল হক তন্ময়কে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ওই তদন্ত টিম ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক তদন্তে বিভিন্ন অনিয়মের কারণে সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেন।
২০১৮ সালের ১৯ জুলাই আলমডাঙ্গার ছোটপুটিমারি গ্রামের তানজেদ আলীর মেয়ে রোজিনার অপারেশন করেন ডা. বিডি দাস পিকলু। অপারেশনের তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে ২য় দফায় আবারও অপারেশন করা হয়। তাতেও সুস্থ না হয়ে তার অবস্থা আরও সঙ্কটজনক হয়। পরে রোজিনাকে রাজশাহী রেফার করা হয়।
এর কিছুদিন পরই ৩ আগস্ট ওই ক্লিনিকে অপারেশনের পরপরই ভুমিষ্ট শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রসূতিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। ওইদিন আলমডাঙ্গা বাবুপাড়ার সোহাগের স্ত্রী সিমা খাতুনের প্রসব বেদনা উঠলে নেয়া হয় ইউনাইটেড ক্লিনিকে। ওইরাতেই ডা. বিডি দাস পিকলু অপারেশন করলে কন্যা সন্তান প্র¯্রব করেন সিমা। এরপরই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে ভুমিষ্ঠ শিশু ও প্রসূতি। তাদের রাজশাহী মেডিকেলে রেফার করলে সেখানকার চিকিৎসক ভুমিষ্ঠ শিশুকে মৃত ঘোষণা করেন।
২০১৮ সালের ২৭ জুলাই আলমডাঙ্গার ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারে অভিযান চালিয়ে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ক্লিনিকের বিভিন্ন কেবিন অপরিস্কার, রোগীদের পচা খাবার পরিবেশন করার অভিযোগে এ জরিমানা করেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাহাত মান্নান।
২০১৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারে বুদো জোয়ার্দ্দার (৫৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। ক্লিনিকের ব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান চৌধুরী চিকিৎসক না হয়েও রোগীর শরীরে ইনজেকশন দেয়ায় এ ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ভুল চিকিৎসায় বুদো জোয়ার্দ্দারের মৃত্যু হয়েছে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তার স্বজন ও বিক্ষুব্ধ লোকেরা ওই ক্লিনিকে ভাঙচুর চালান। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সেসময় ক্লিনিকের ব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান চৌধুরী এবং ক্লিনিকের অংশীদার সাব্বির রহমানের বাবা সাইদুর রহমানকে (৫০) আটক করে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় উপজেলা প্রশাসন।
এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. এএসএম মারুফ হাসান বলেন, আমি ঘটনাটি শুনেছি। বিষয়টি পরিস্কার হওয়ার জন্য ওই নবজাতকের মরদেহ ময়না তদন্তের জন্য সদর হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন হবে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেলে ওই ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর : ড. আমানুর আমান,এম.ফিল (আইইউকে), পিএইচডি ( এনবিইউ- দার্জিলিং)
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: শাহনাজ আমান।
কার্যালয়:- থানা ট্রাফিক মোড়, কুষ্টিয়া।মোবাইল- ০১৭১৩-৯১৪৫৭০, ইমেইল: info.dailykushtia@gmail.com
ই-পেপার কপি