October 30, 2024, 8:01 pm
ড. আমানুর আমান, সম্পাদক ও প্রকাশক দৈনিক কুষ্টিয়া ও দি কুষ্টিয়া টাইমস/
উপমহাদেশের প্রখ্যাত চারণকবি বিজয় সরকারের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (৪ ডিসেম্বর)। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এ এ মানুষটি ছিলেন একাধারে, গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তিনি ১৯০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নড়াইল সদর উপজেলার বাঁশগ্রাম ইউনিয়নের ডুমদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নাম নবকৃষ্ণ অধিকারী এবং মার নাম হিমালয়া দেবী। দশ ভাইবোনের মধ্যে বিজয় ছিলেন সবার ছোট। প্রকৃত নাম বিজয় অধিকারী।
বিজয় একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী। গায়কী ঢঙে তনিি চারণকবি ও ‘সরকার’ উপাধি লাভ করেন।
তার শৈশবকাল এবং জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে প্রিয় জন্মভূমি ডুমদিসহ নড়াইলের বিভিন্ন এলাকায়। ছেলেবেলা থেকেই বিজয় কবিতা, গান রচনা ও সুরের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন। তার পড়াশোনা টাবরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এ সময়েই তিনি নেপাল বিশ্বাস নামক একজন শিক্ষকের কাছে যাত্রাগানের উপযোগী নাচ, গান ও অভিনয় শেখেন।
অল্প বয়সে পিতামাতা হারানোয় তার লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি। মাত্র নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই তার লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটে। মতান্তরে তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে তিনি স্থানীয় স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতার কাজ করেন। আবার কিছুদিন করেন নায়েবের কাজ। পাশাপাশি তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের লোক ও আধুনিক গান চর্চা করতেন।
১৯২৯ সালে বিজয় সরকার নিজের একটি গানের দল তৈরি করেন। এরপরই কবিয়াল হিসেবে তার পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯৩৫ সালে কলকাতার এ্যালবার্ট হলে কবি গানের এক আসরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসিম উদ্দিন, কবি গোলাম মোস্তফা, কণ্ঠ শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহম্মেদ উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা বিজয় সরকারের গান শুনে মুগ্ধ হন এবং তাকে আশীর্বাদ করেন।
তিনি একাধিকবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ডক্টর মোঃ শহিদুল্লাহ, দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, বিশ্ব নন্দিত চারু শিল্পী এস.এম, সুলতানসহ অসংখ্য গুণীজনের সান্নিধ্য লাভ করেছেন। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ‘ভারতীয় ভাষা পরিষদ’ তাকে সংবর্ধনা দেয়। এ অনুষ্ঠানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর দেবীপদ ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন।
ভাটিয়ালী সুরের উপর ভিত্তি করে তার ধুয়া গানের জন্য তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা পান। জনপ্রিয় এই কবিয়ালকে বিচ্ছেদী গানের পথিকৃৎ বলা যায়।
বিজয় সরকার প্রায় ৪০০ সখি সংবাদ এবং ধুয়া গান রচনা করেন। এর মধ্যে কিছু কাজ বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত হয়। তিনি বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, এবং রেডিও-টেলিভিশনেও কবিগান পরিবেশন করেন। বাংলাদেশ ও ভারতে তিনি আনুমানিক ৪০০০ আসরে কবিগান পরিবেশন করেন।
সব মিলিয়ে তিনি প্রায় এক হাজার ৮০০ গান রচনা করেছেন। অনেক ইসলামী গান ও কবিতা রচনা করেছেন সঙ্গীতপ্রাণ এই কবি ও গায়েন। কবিগানের আসরেও দুর্দান্ত ছিলেন তিনি। মাতিয়ে তুলতেন দর্শক-শ্রোতাদের। কোনও কোনও মঞ্চে তৎক্ষণাৎ নিজের রচিত আধ্যাত্মিক গান পরিবেশন করে তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের মুগ্ধ করতেন। এছাড়া তিনি রামায়ণ গানও পরিবেশন করতেন।
বিজয়ের দু’ছেলে কাজল অধিকারী ও বাদল অধিকারী এবং মেয়ে বুলবুলি ভারতে বসবাস করেন। ১৯৮৫ সালের ৪ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কেউটিয়ায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যুর হয়। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।
শিল্পকলায় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৩ সালে একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত হন উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই চারণ কবি।
Leave a Reply